১০ জুলাই ২০২১, শনিবার, ৭:৪৭

যমুনার ভাঙনে দিশেহারা মানুষ

তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে

তিস্তা, ধরলা আর ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। অন্য দিকে যমুনার ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরের মানুষ।
রংপুর অফিস জানায়, ভারতের গাজলডোবা গেটের সব কয়টি গেট খুলে দেয়ায় উজানের পানি আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইসগেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যা আকস্মিক বন্যায় রূপ নিয়েছে। ধরলা, ব্রহ্মপুত্রেরও একই অবস্থা। ফলে তিস্তা অববাহিকার ১৫২ কিলোমিটার এবং ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র এলাকার ৩৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চরাঞ্চল ছাড়াও নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল এবং চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ এখন পানিবন্দী। হাজার হাজার হেক্টর জমির বাদাম, ভুট্টা, পাট ও বোরোধান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। শত শত পুকুর তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সাথে সমানতালে চলছে ভাঙন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এই অববাহিকা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ছয় সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর পরপরই বাড়তে থাকে পানিপ্রবাহ। রাত সাড়ে ৯টায় পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপরে (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার), রাত দশটায় ৫২ দশমিক ৮৩ বিপদসীমার ২৩ এবং রাত ১১টায় ৫২ দশমিক ৯০ যা বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। ব্যারাজ রক্ষায় ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার (৬ জুলাই) বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার এবং বুধবার (৭ জুলাই) ৩০ সেন্টিমিটার নিচে ছিল তিস্তা নদীর পানি।
শুক্রবার সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে ২০ এবং ৯টায় ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাড়তে থাকে রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে। সকাল ১০টায় বিপদসীমা ২৯ দশমিক ২০ সেন্টিমিটার ছুঁইছুঁই করলেও ১১টায় তা বিপদসীমা অতিক্রম করে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা আরো জানান, গজলডোবার সব কয়টি গেট খুলে দেয়া এবং পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে উজানে উজানে ভয়াবহ রকম পানি বৃদ্ধি পায়। এ কারণে ভাটিতে পাঁচ জেলার ১৪ উপজেলায় তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে। তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র, যমুনেশ্বরী, টাঙ্গন, পুনর্ভবা, ইছামতি নদীর চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। দেখা দিয়েছে ভাঙন। এ ছাড়া তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় নদীতীরবর্তী বিভিন্ন স্থানের বাঁধে আঘাত করছে। ফলে বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ি ঢল এবং ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের বন্যা দেখা দিবে এই অঞ্চলে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি।
সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, যমুনা নদীর ভাঙনে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের নদীতীরবর্তী মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হচ্ছে এসব এলাকার শতশত বাড়িঘর, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বর্ষা মৌসুম আসার আগে থেকেই এই ভাঙন শুরু হয়েছে।
সরেজমিন জানা যায়, তিন সপ্তাহ ধরে যমুনার পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাঙনের তাণ্ডব চলছে। ইতোমধ্যে শাহজাদপুর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের নদীতীরবর্তী অঞ্চলের প্রায় তিনশত বিঘা ফসলি জমি, দুইশতাধিক বাড়িঘর ও শতশত গাছপালা যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া আরো ফসলি জমি ও বাড়িঘর বিলীন হওয়ার পথে। খুকনি ইউনিয়নের আরকান্দি, জালালপুর ইউনিয়নের জালালপুর, ঘাটাবাড়ি ও পাকুরতলা, কৈজুরি ইউনিয়নের হাটপাঁচিল, সোনাতনী ইউনিয়নের পশ্চিম বানতিয়ার, ছোট চানতারা, বড় চানতারা, ধীতপুর, দইকান্দি ও বানিয়া সিংগুলী, গালা ইউনিয়নের আগবাঙ্গলা ও ধলাই গ্রামের হাজারো নদীতীরবর্তী মানুষ ভাঙনে ফসলি জমি ও ভিটেমাটি হারিয়েছেন এবং এখনও ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন। কৈজুরি গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ জানান, যমুনার ভাঙনে জমিজমা ও বাড়িঘর হারিয়ে আমরা পথের ফকির হয়ে গেছি। আমরা এখন কেমন করে চলবো বুঝতে পারছি না।
শাহজাদপুর উপজেলার নদীতীরবর্তী জালালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ বলেন, এবার বন্যা মৌসুম শুরুর আগে থেকেই যমুনায় ভাঙন শুরু হয়েছে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। তিনি আরো বলেন, গেল তিন সপ্তাহে পাঁচটি ইউনিয়নের তিনশত বিঘা ফসলি জমি ও অন্তত দুইশতাধিক বাড়িঘর নদীতে চলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বারবার বলা সত্ত্বেও তারা সময়মতো ব্যবস্থা নেয়নি। ফসলি জমি ও বাড়িঘর রক্ষায় এলাকাবাসী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো: শামসুজ্জোহা বলেন, ভাঙনকবলিত এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
ইসলামপুর (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে জামালপুরের ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র ও দশানী নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে দুই উপজেলায় তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে।
গত চার দিনে জেলার ইসলামপুরে শতাধিক ও দেওয়ানগঞ্জে পাঁচ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি, বাজার, মসজিদ ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাহাদুরাবাদ নৌথানা। ইসলামপুরের চরপুঁটিমারী ইউনিয়নে দশআনী নদীর বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। এক সপ্তাহে এলাকায় প্রায় শতাধিক বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়েছে।
দেওয়ানগঞ্জের চুকাইবাড়ী ইউনিয়নের চর হলকা, হাবড়াবাড়ী গুচ্ছগ্রাম, টিনেরচর এলাকায় পাঁচ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি যমুনায় বিলীন হয়েছে।
চিকাজানি ইউনিয়নের খোলাবাড়ী, হাজরাবাড়ী, চর মাগুরী হাট, মন্ডল বাজার, প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাহাদুরাবাদ নৌথানা, দেওয়ানগঞ্জ-খোলাবাড়ী সড়ক হুমকির মুখে রয়েছে। বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের ঝালোর চর, চর বাহাদুরাবাদ, পৌল্লাকান্দি, ঝালোরচর বাজার মসজিদ, ঐতিহ্যবাহী ঝালোরচর বাজার, হাতীভাঙ্গা ইউনিয়নের সবুজপুর, পশ্চিম কাঠারবিল, চর আমখাওয়া ইউনিয়নের জিঞ্জিরাম নদীতে, পশ্চিম সানন্দবাড়ী, লম্বাপাড়া, সবুজপাড়া, ডাংধরা ইউনিয়নের পাথরের চর, মাখনের চর বিলীন হচ্ছে।
বগুড়ায় নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি চরের নিচু এলাকা প্লাবিত
বগুড়া অফিস জানান, কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা এবং বাঙালি নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত হয়েছে।
সারিয়াকান্দি পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনো বিপদসীমার নিচেই রয়েছে পানি। পানি বাড়ার কারণে যমুনার ডাকাতমারা, মূলবাড়ী, ইন্দুরমারা, কাজলা, বেনিপুর, বাওইটোনা, বেড়াপাঁচবাড়িয়া, চরদলিকা, চালুয়াবাড়ী, বেনিপুর, শোনপচা, চরঘাগুয়া চরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
সারিয়াকান্দিতে দায়িত্বে থাকা গেজ রিডার পরশুরাম জানিয়েছেন, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত যমুনা নদীতে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার যা বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপর দিকে বাঙালি নদীতে পানির উচ্চতা ছিল ১৪ দশমিক ৮৫ সেন্টিমিটার যা বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ তাসকিয়া বলেছেন, গত কয়েক দিন ধরেই যমুনা এবং বাঙালি নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে কয়েক দিনের মধ্যে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: রাসেল মিয়া বলেন, লকডাউনে নৌপথে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো নৌকা বের হতে দেয়া হচ্ছে না। তবে নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নৌরুটের গতিপথ স্বাভাবিক হয়ে শুধু যে চরবাসীরাই উপকৃত হচ্ছেন তা ঠিক নয়। নৌযানের সাথে সম্পৃক্ত থেকে অনেক মানুষই তাদের কর্মসংস্থান ফিরে পেয়েছেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/593975/