২৫ জুন ২০২১, শুক্রবার, ১:১৩

চাকরি হারিয়েছেন ৩৪ শতাংশের কেউ না কেউ

করোনায় আয় হ্রাস ৭৭ ভাগ পরিবারের

ব্র্যাকের জরিপ

কোভিড-১৯ মহামারীতে গত বছরের এপ্রিল-অক্টোবর সময়কালে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে স্বল্প আয় ও অনানুষ্ঠানিক খাতে থাকা ব্যক্তিরা চাকরি ও উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। এই সময়ে ৭৭% পরিবারে করোনার কারণে গড় মাসিক আয় কমেছে এবং ৩৪% পরিবারের কেউ না কেউ চাকরি অথবা আয়ের সক্ষমতা হারিয়েছেন।
এই সময়ে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে পরিবারগুলো সঞ্চয় ও ধারদেনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে পরিবারগুলোর গড় মাসিক সঞ্চয় ৬২ ভাগ কমে গেছে, ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩১ শতাংশ। ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। এই গবেষণায় করোনাকালে বিপরীতমুখী অভিবাসনের প্রভাবে বাংলাদেশের মধ্যম মানের শহর, উপজেলা এবং গ্রামীণ অঞ্চলে জনমিতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশের ওপর পরিবর্তনগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
‘কোভিড-১৯-এর কারণে জনমিতিক ও আর্থসামাজিক পরিবর্তনসমূহ : নতুন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য ও ফলাফল গত বুধবার রাতে একটি ভার্চুয়াল আন্তর্জাতিক সংলাপের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সেন্টার অন ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন-এর প্রোগ্রাম লিড লিয়া জেমোর এই অনলাইন আলোচনা সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন ব্র্যাক বাংলাদেশ-এর ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ। উপস্থাপনা শেষে আলোচনায় অংশ নিয়েছেনÑ ইউএন উইমেন বাংলাদেশ-এর আবাাসিক প্রতিনিধি শোকো ইশিকাওয়া, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. ডেনিয়েল নাওজোকস এবং ব্র্যাক ইউএসএ-এর পরিচালক (স্বাস্থ্য) ড. এডাম সোয়ার্টজ।
সংখ্যাবাচক ও পরিমাণবাচক উভয় পদ্ধতি প্রয়োগে পরিচালিত গবেষণাটির সময়কাল ২০২০ সালের ১০-২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত, যাতে ছয় হাজার ৩৭০টি খানা অংশগ্রহণ করে। এতে গত বছরের এপ্রিল-অক্টোবর সময়কালকে ভিত্তিকাল (রেফারেন্স পিরিয়ড) হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। করোনাকালে বিবিধ পরিস্থিতির শিকার হয়ে যারা দেশ ও দেশের বাইরে থেকে নিজ বাসভূমে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের জীবনযাত্রায় সামগ্রিক প্রভাবের ওপর এই গবেষণায় বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে। গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পরিবারগুলোর ৬১ শতাংশেই তাদের অন্তত একজন সদস্য কোভিড-১৯ মহামারীতে চাকরি বা উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। আবার গ্রামাঞ্চল বা মফস্বল শহরে ফিরে আসা আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের প্রায় ৭৭% মনে করেন কাজ বা চাকরি খুঁজে পাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
সমীক্ষায় অংশ নেয়া খানাগুলোতে প্রায় ২৫% ফেরত আসা আন্তর্জাতিক অভিবাসী অভিবাসন ঋণ পরিশোধ নিয়ে উদ্বিগ্ন, যার পরিমাণ ৭৬ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ সাত লাখ টাকা পর্যন্ত। শতকরা ৪৪ ভাগ জানিয়েছেন, তারা কোনো উপার্জনমূলক কাজ পাননি। তাদের মধ্যে কিছু পরিবার সঞ্চয় উত্তোলন করে বা বিভিন্ন সম্পদ ভাড়া বা বন্ধক দিয়ে খরচ চালিয়ে যাচ্ছে। জরিপকৃত পরিবারগুলোতে মহামারী চলাকালীন সময়ে গড়ে মাসিক রেমিট্যান্স বা বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থ ৫৮% হ্রাস পেয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রাম বা মফস্বল শহরগুলোতে ফিরে আসা পরিবারগুলো বিদ্যমান স্থানীয় অপ্রতুল সম্পদ বিশেষত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। অভিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৪.৫৭% স্কুলের শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের গড় বয়স ৫-১৬ বছর। পুনরায় স্কুল খোলার পর যদি তারা তাদের পূর্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরত না যেতে পারে তবে স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া ফেরত আসা প্রায় ১৩.৩৫% জনগোষ্ঠীর (অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় অভিবাসী) বয়স চল্লিশোর্ধ্ব এবং ৪.৫৬%-এর বয়স পঞ্চাশের ওপরে যাদের ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এ বিষয়টি স্থানীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর বিশেষ করে অসংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
ফেরত আসা নারীদের মধ্যে বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী পরিবারগুলোর নারীরা করোনাকালীন সময়ে বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, যা এই গবেষণায় উঠে এসেছে। যেমন কোনো উৎপাদনশীল বা আয়মূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে না পারা (৭৪%), রাস্তাঘাট ও বাজারে স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারা (২৬.৮%), স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে সমস্যা অনুভব করা এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাব বোধ করা (২০%), গৃহস্থালি কাজের চাপ বৃদ্ধি এবং শিশু লালন-পালন এবং সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে সমস্যা অনুভব করা (১৮%)।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী ওই সময়ে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে। বিয়ের সময় কনে কোন শ্রেণীতে পড়ত তার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় জরিপকালে অনুষ্ঠিত বিয়ের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠানের সময় তিন-চতুর্থাংশের বেশি (৭৭%) কনের বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে এবং ৬১% কনের বয়স ছিল ১৬ বছরের কম।
গবেষণার তথ্য ও ফলাফল উপস্থাপনের পর নীতিবিষয়ক আলোচনায় শোকো ইশিকাওয়া বলেন, বাংলাদেশে দেড় বছরের উপরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। অন্য দিকে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শেখার সুযোগও অত্যন্ত সীমিত। দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়া পরিবারগুলো কন্যাসন্তানদের বাল্যবিবাহের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে এসব পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/590456