২৬ জুন ২০২১, শনিবার, ১:১১

করোনার ধাক্কায় দেশে বেড়েছে বেকারত্ব কমছে উৎপাদন

করোনার ধাক্কা দেশের শিল্প এবং উৎপাদন খাতে। ওষুধসহ হাতে গোনা কয়েকটি পণ্যের উৎপাদন বাড়লেও অন্য সব শিল্পপণ্যের উৎপাদনে ব্যাপক ধস নামে। করোনায় বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে অতি দরিদ্র্যের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। পিপিআরসি ও ব্র্যাকের সাম্প্রতিক গবেষণা জরিপ বলছে, করোনার এক বছরে দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের জীবনমান নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, সংখ্যায় তা প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ।

করোনার কারণে দেশে দেশে এই সংকট তীব্র হচ্ছে। বেশির ভাগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) সংকোচন হবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে। কর্মহীন হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, গত (২০১৯-২০) অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরলেও ৫.১ শতাংশ হতে পারে।

অর্থনীতি আগের জায়গায় ফিরে যেতে সময় লাগবে। এ ছাড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কতটা গভীর হয়, এর ওপর নির্ভর করছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কতটা ত্বরান্বিত হবে। তাই ওই সব সংস্থা চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে।

দুই দশকে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য কমেছিল। তবে করোনাকালে নতুন করে দরিদ্রের কাতারে যোগ হয়েছে অনেক মানুষ। পিপিআরসি ও ব্র্যাকের সাম্প্রতিক গবেষণা জরিপ বলছে, করোনার এক বছরে দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের জীবনমান নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, সংখ্যায় তা প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ।

করোনার আগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে সাড়ে তিন কোটিতে নেমে এসেছিল। সংস্থা দুটির প্রাক্কলন বিবেচনায় নিলে এখন দরিদ্রের সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি। যদিও এটি প্রকৃত অর্থে গবেষণা নয়, বরং জরিপটি টেলিফোনে করা বলে প্রকৃত সংখ্যাটি নিয়েও সন্দেহ থাকতে পারে, তবে করোনাকালে দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল এমনকি ক্ষুদ্র আয়ের জনগোষ্ঠী যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। নতুন করে সরকার আবারও শাটডাউন দেয়া চিন্তা ভাবনা করছে। শিল্পকারখানা খোলা থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট অনেকাংশে বন্ধ। এতে অর্থনীতি, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানে বড় ধরনের ধস দৃশ্যমান। এ অবস্থায় মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কায় দারিদ্র্য হার আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যের কোটায় অন্তর্ভুক্তি দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।

করোনাকালে দারিদ্রতার হার দ্রুত বাড়ার প্রধান কারণ মানুষের কর্মহীনতা ও আয় হ্রাস। গত বছর করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রায় আড়াই মাস সাধারণ ছুটি ছিল। ওই সময় কৃষি খাতে শস্য উৎপাদন, সংগ্রহ ও সামাজিক দূরত্ব মেনে বিপণন ছাড়া অন্য প্রায় সব খাতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
গণপরিবহন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্যুরিজমসহ বন্ধ হয়ে পড়ে জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা সেবা খাত। বন্ধ থাকে কাঁচাবাজার, ওষুধ ও নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকান বা বাজার। এর অভিঘাত পড়ে অনানুষ্ঠানিক খাতে।

ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী কাজ হারায়। পরে সবকিছু খুলে দেওয়া হলেও অনেকেই আর কাজে ফিরতে পারেনি। অন্যদিকে বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে অনেকের আয় বাড়েনি। ফলে তাদের জীবনমান দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। চলমান লকডাউনেও একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সবকিছু বন্ধ থাকায় শ্রমজীবীদের বড় অংশেরই কাজ নেই। এতে দারিদ্র্য যে আরও বাড়বে, তা সহজেই অনুমেয়। এ অবস্থায় যথাযথ তালিকা করে দরিদ্রদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসুচি জোরদার করাটা জরুরি।
৮ অক্টোবর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদনের আগাম পূর্বাভাস, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। বিশ্বব্যাংক কারণ হিসেবে দেখিয়েছে, অর্থনীতিতে শ্লথগতি। অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীদের আয় কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে ভোগ করার প্রবণতা কমে গেছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বেশ ভালো পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। তাই চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে এই দাতা সংস্থাটি। চীন, ভারত ও মালদ্বীপের পরই সবচেয়ে প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশে।

এডিবি বলছে, বাংলাদেশ ৩০ দেশের মধ্যে ২৬তম। বাংলাদেশের পেছনে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও আফগানিস্তান। এই তালিকায় শীর্ষে আছে তাইপে। এর পরেই সিঙ্গাপুরের অবস্থান।
প্রবৃদ্ধিতে চতুর্থ শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে শুরুতে অর্থনীতি আরও বেগবান হবে বলে মনে করে এডিবি। করোনা সংকট বেশি দিন ধরে বিরাজমান থাকলে তা কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে এডিবি। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ওই ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে এডিবি প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সুখ সূচকও দেখিয়েছে। সেখানে আমাদের জন্য ভালো খবর নেই।

করোনার কারণে দেশে-বিদেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেড়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের পভার্টি এন্ড শেয়ারড প্রসপারিটি ২০২০ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে বিশ্বের অতি দারিদ্র্যের হার ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশের বেশি হয়েছে। করোনায় কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে অতি দরিদ্র্যের খাতায় নাম লিখিয়েছেন।

চলতি অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আরেক সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে বাংলাদেশে গরিব লোকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। দারিদ্র্য হার সাড়ে ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২ শতাংশ হয়েছে। যারা দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার আয় করতে পারেন না, তাঁদের দরিদ্র হিসেবে ধরে বিশ্বব্যাংক।

করোনাকালে বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক গবেষণা আছে। সব প্রতিষ্ঠানই বলেছে, দারিদ্র্য বেড়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলেছে, গত এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে দারিদ্র্য হার ১৯ থেকে বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে। কমবেশি ১ কোটি ৬৪ লাখ নতুন করে গরিব হয়েছেন। এ ছাড়া আগে থেকেই সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, করোনায় দারিদ্র্য হার ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত জুন মাসে পিপিআরসি ও বি আইজিডির যৌথ গবেষণায় এসেছে, দারিদ্র্য হার দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা জানতে গত সেপ্টেম্বরে একটি জরিপ করেছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, করোনায় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চে প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা।
দারিদ্র্য বেড়েছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর করোনায় শ্রমজীবী মানুষের আয় কমেছে। লাখ লাখ কর্মজীবী বেকার হয়ে গেছেন। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা জানতে গত সেপ্টেম্বরে একটি জরিপ করেছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, করোনায় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চে প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা। পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা।

পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় বেকারত্ব ওই সময়ে দশ গুণ বেড়ে যায়। আড়াই শতাংশ বেকারত্ব হার পৌঁছে দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থনীতি খুলতে শুরু করায় জুলাই থেকে বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়। সেপ্টেম্বরে এসে বেকারত্বের হার আবার ৪ শতাংশে নেমে আসে। এত দ্রুত বেকার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ করোনার প্রথম তিন-চার মাস যত বেকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এখনো কাজ পাননি। চাকরির বাজার এখনো আগের পর্যায়ে ফিরে আসেনি।

পিপিআরসি ও বিআইজিডি গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার প্রথম দিকে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন মাসে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দীর্ঘ মেয়াদে ছুটি ও লকডাউনের প্রভাবে গত এপ্রিল মাসে গরিব মানুষের আয় ৭৫ শতাংশ কমেছে। আর গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের আয় ৬৫ শতাংশ কমেছে।

গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে সেই তৈরি পোশাকের উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমেছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত এপ্রিল-জুন সময়ে ৩২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকার পোশাক উৎপাদন হয়েছে।

গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের উৎপাদন খাত সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল। সাবান, ডিটারজেন্টসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী, ওষুধসহ হাতে গোনা কয়েকটি পণ্যের উৎপাদন বাড়লেও অন্য সব শিল্পপণ্যের উৎপাদনে ব্যাপক ধস নামে। বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ ছিল কিংবা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্পপণ্য হিসেবে তৈরি পোশাককে ধরা হয়। এটি আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্য এবং অর্থনীতির চালিকা শক্তি।

https://dailysangram.com/post/456714