১৯ জুন ২০২১, শনিবার, ১২:২৯

ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সবশিশুরই অন্তরে

আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যত। শিশুরাই আগামীতে দেশ, জাতি, সমাজ এবং পৃথিবী পরিচালনা করবে। তাই শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন দেশ এবং জাতিগোষ্ঠী যেমন ভাবে, তেমনই ভাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও। ভাবেন বিশ্বনেতারাও। কিন্তু এতদসত্ত্বেও পৃথিবীতে শিশুদের পরিশ্রম করে পেটের খাবার জোগাড় করতে হয়। মাঠে-ময়দানে, কলে-কারখানায়, দোকানে, বাসাবাড়িতে শ্রম বিকোতে হয় শিশুদের। বলাবাহুল্য, শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা কিন্তু কম না। কোটি কোটি। এ বিপুল সংখ্যক শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয় অমানবিক শ্রম দিতে গিয়ে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে।

গত ১২ জুন, ২০২১ তারিখে নিউইয়র্ক, জেনেভা ও ঢাকা থেকে একযোগে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও এবং ইউনিসেফের নতুন এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে। গত চার বছরে বেড়েছে ৮৪ লাখ। কোভিড-১৯ এর প্রভাবের কারণে আরও লাখ লাখ শিশু রয়েছে ঝুঁকিতে।

গত ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধদিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ‘চাইল্ড লেবার: গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২০, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক রিপোর্টে সতর্ক করে বলা হয়েছে, শিশুশ্রম বন্ধে অগ্রগতি গত ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো থমকে গেছে, যা আগের নিম্নমুখী প্রবণতাকে উল্টে দিচ্ছে। ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা কমে ৯ কোটি ৪০ লাখে নেমে এসেছিল।
রিপোর্টে শিশুশ্রমে নিযুক্ত ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে। এমন শিশুর সংখ্যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত মোট শিশুর অর্ধেকের কিছু বেশি। শিশুদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নৈতিকতার ক্ষতি করতে পারে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ২০১৬ সালের পর ৬৫ লাখ বেড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখে পৌঁছেছে।

আইএলও’র মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেন, “নতুন এ হিসাব একটি সতর্ক সংকেত। যখন নতুন একটি প্রজন্মের শিশুদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে তখন আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও পরিবারগুলোকে তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠানোর সুযোগ করে দেয়। পল্লী উন্নয়নে বর্ধিত বিনিয়োগ এবং কৃষিখাতের উন্নয়নে যথোপযুক্ত কাজের সুযোগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আছি এবং আমাদের প্রতিক্রিয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এ অবস্থাকে বদলে দিতে এবং দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমের চক্র ভেঙে দিতে নতুন প্রতিশ্রুতি ও শক্তির সম্মিলন ঘটানোর এখনই সময়।”
সাব-সাহারা আফ্রিকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বারবার ফিরে আসা সংকটময় পরিস্থিতি, চরম দারিদ্র্য এবং অপর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গত চার বছরে অতিরিক্ত ১ কোটি ৬৬ লাখ শিশুকে শ্রমের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

এমনকি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের মতো যেসব অঞ্চলে ২০১৬ সালের পর থেকে কিছু অগ্রগতি হয়েছে সেখানেও কোভিড-১৯ এ অগ্রগতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
রিপোর্টে সতর্ক করে বলা হয়েছে, মহামারির কারণে ২০২২ সাল সমাপ্ত হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ৯০ লাখ শিশু শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। পরিস্থিতি অনুকরণে তৈরি একটি মডেলে (সিমিউলেশন মডেল) দেখা গেছে, এ সংখ্যাটি বেড়ে ৪ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছতে পারে, যদি তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা না হয়।
কোভিড-১৯-এর কারণে বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ এবং স্কুল বন্ধের কারণে ইতোমধ্যে শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের হয়তো দৈনিক আরও দীর্ঘ সময় ধরে বা আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে ঝুঁকির মুখে থাকা পরিবারগুলোতে কাজ হারানো বা আয় কমে যাওয়ার কারণে আরও অনেক শিশু হয়তো সবচেয়ে খারাপ ধরনের শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, “শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি এবং গত বছরটি এ লড়াইকে কোনওভাবে সহজতর করে তোলেনি। এখন বিশ্বব্যাপী লকডাউন, স্কুল বন্ধ থাকা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন এবং জাতীয় বাজেট ক্রমেই সংকুচিত হওয়ার দ্বিতীয় বছরে অনেক পরিবার হৃদয়-বিদারক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। শিশুদের কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরিয়ে এনে স্কুলে ফেরাবার লক্ষ্যে কর্মসূচি এবং পরিবারগুলো যাতে শিশুদের কর্মক্ষেত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে সর্বাগ্রে সরে আসতে পারে এমন সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ করাকে অগ্রাধিকার প্রদানে সরকার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর প্রতি আমরা আহ্বান জানাই।”

রিপোর্টে উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে:
শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ১১ কোটি ২০ লাখ কৃষিখাতে নিয়োজিত। বাকিদের মধ্যে ২০ শতাংশ ৩ কোটি ১৪ লাখ সেবাখাতে এবং ১০ শতাংশ ১ কোটি ৬৫ লাখ শিল্পখাতে নিয়োজিত রয়েছে।
শিশুশ্রমে নিয়োজিত ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ২৮ শতাংশ এবং ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের ৩৫ শতাংশ স্কুলের বাইরে রয়েছে।
সববয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেই মেয়েদের তুলনায় ছেলে শিশুদের শিশুশ্রমে নিযুক্ত হওয়ার হার বেশি। সপ্তাহে অন্তত ২১ ঘণ্টা গৃহস্থালী কাজে সম্পৃক্ত থাকে এমন শিশুদের বিবেচনায় নিলে শিশুশ্রমে জেন্ডার ব্যবধান কমে আসে।
গ্রামাঞ্চলে শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার হার ১৪ শতাংশ, শহরাঞ্চলের ৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে প্রায় তিনগুণ বেশি।

আইএলও’র বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিআইনেন বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোর অগ্রগতি যাতে না হারিয়ে যায়, সেকারণে বাংলাদেশকে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইকে এজেন্ডার শীর্ষে রাখতে হবে। কেবল শিশুশ্রমিক এবং ঝুঁকির মুখে থাকা শিশুদের জন্যই নয়, পিতা-মাতা এবং জ্যেষ্ঠ ভাই-বোনদের জন্য উপযুক্ত কাজের সুযোগ প্রদান করার লক্ষ্যেও, বাধ্যতামূলক শিক্ষা, দক্ষতা বিকাশ, এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে গুরুত্ব দিয়ে আমরা আমাদের অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ চালিয়ে যাবো। দেশের জনমিতিক লভ্যাংশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর সর্বোচ্চ সুবিধা পাবার লক্ষ্যে দক্ষ, স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনশীল শ্রমশক্তি তৈরির ব্যবস্থা জোরদার করবার এখনই সময়।”

শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুরা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। শিশুশ্রম শিশুদের পড়াশোনাকে ব্যাহত করে। তাদের অধিকার ও ভবিষ্যতের সুযোগগুলোকে সীমিত করে দেয় এবং তাদের দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমের আন্তঃপ্রজন্মগত দুষ্টচক্রে পড়বার দিকে ধাবিত করে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, “মহামারির মাঝে গত মার্চ ২০২০ থেকে স্কুল বন্ধ থাকা এবং দারিদ্র্যবৃদ্ধি আরও অনেক শিশুকে শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা নিয়ে ইউনিসেফ উদ্বিগ্ন। এ পরিস্থিতিতে পরিবারগুলোর বেঁচে থাকবার লড়াই করতে হচ্ছে এবং তার জন্য তারা সকল পন্থাই অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আমাদের এখন শিশুদের প্রয়োজনগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং এ ক্ষতিকারক শিশুশ্রমের মূলে যেসব সামাজিক সমস্যাগুলো রয়েছে তা নিরসনে জোর দেয়া প্রয়োজন।”

শিশুশ্রমের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাকে উল্টে দিতে আইএলও এবং ইউনিসেফ আহ্বান জানাচ্ছে: সর্বজনীন শিশুসুবিধাসহ সবার জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। মানসম্মত শিক্ষার পেছনে ব্যয় বাড়ানো এবং কোভিড-১৯-এর আগে থেকেই স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদেরসহ সবশিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যথোপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করবার বিষয়টি তুলে ধরা, যাতে পরিবারগুলোকে পারিবারিক উপার্জন বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে শিশুদের অবলম্বন করতে না হয়। শিশুশ্রমকে প্রভাবিত করে এমন ক্ষতিকারক জেন্ডারগত রীতিনীতি এবং বৈষম্যের অবসান ঘটানো। শিশু সুরক্ষাব্যবস্থা, কৃষিজ উন্নয়ন, পল্লী জনসেবা, অবকাঠামো এবং জীবন-জীবিকার পেছনে বিনিয়োগ করা।

শিশুশ্রম নির্মূলের আন্তর্জাতিক বর্ষের অংশ হিসেবে বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের জোট অ্যালায়েন্স ৮.৭ - আইএলও এবং ইউনিসেফ যার অংশীদার। সদস্য রাষ্ট্রসমূহ, ব্যবসায়িক খাত, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে তাদের প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করতে আহ্বান জানাচ্ছে।

নতুন বৈশ্বিক হিসাব প্রকাশ এবং এগিয়ে যাওয়ার রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের সময় ১০-১৭ জুন সপ্তাহব্যাপী কার্যক্রম চলাকালে আইএলও মহাপরিচালক গাই রাইডার ও ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচারক হেনরিয়েটা ফোর অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের বক্তা ও যুব প্রতিনিধিদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

ইউনিসেফসহ বিশ্বশিশু উন্নয়নমূলক বেশকিছু সংস্থা শিশুদের জন্য কাজ করছে। খরচ হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এবং ইউরো। কিন্তু প্রকৃত শিশুউন্নয়ন তেমন চোখে পড়ে না। শিশুদের দুর্দশা বাড়তেই থাকে। এবার মহামারি করোনা শিশুদের দুর্গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এমতাবস্থায় শিশুকল্যাণ ও উন্নয়নে উন্নত বিশ্ব এবং সরকারপ্রধানদের বিশেষ মনোযোগ দেয়া জরুরি। কারণ শিশুরা ভালো না থাকলে পৃথিবীর মানুষ ভালো থাকবে না। সমাজ বিনির্মাণ হবে না। আজকে যারা শিশু আগামীতে তারাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত। পিতা এবং মাতা। সমাজপরিচালক। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক। এ জন্যই কবি বলেছেন, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সবশিশুরই অন্তরে। শিশুর সার্বিক কল্যাণে সর্বতোভাবে সবাই মনোযোগ দেবেন এ হচ্ছে আমাদের প্রত্যাশা।

https://dailysangram.com/post/455997