১১ জুন ২০২১, শুক্রবার, ১:১৪

টিসিবি’র ট্রাকে ক্রেতার দীর্ঘলাইন থামছে না

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের দীর্ঘলাইন থামছে না। এখন সবচেয়ে বেশি মানুষ লাইনে দাড়ান তেলের জন্য। বাহিরে সেখানে এক কেজি সয়াবিল তেলের দাম ১৫৩ টাকা সেখানে টিসিবির ট্রাকে দাম মাত্র ১০০ টাকা। এছাড়াও চাহিদা রয়েছে মুসর ডাল, পেঁয়াজ এবং আটার। প্রতিদিনই মানুষ ট্রাকে দাঁড়িয়ে তাদের চাহিদা মত পণ্য সংগ্রাহ করছে। ক্রেতারা বলছেন, ঢাকা শহরে আরও অন্তত ১০০ ট্রাক দেয়া দরকার। তাহলে বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে।

গত রোববার থেকে আবারও পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সাধারণ মানুষ আগের মতো, আগের দামেই টিসিবির পরিবেশকদের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ ট্রাক থেকে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্য পণ্য কিনতে পারবেন।

টিসিবি কোভিড-১৯ চলাকালে সাধারণ আয়ের জনগণের কাছে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ভ্রাম্যমাণ ট্রাক ও ডিলারের মাধ্যমে বিক্রয় কার্যক্রম শুরু করে। এর আগে গেল রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ জনসাধারণের প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিত ও নির্বিঘœ রাখার লক্ষ্যে গত ৩০ এপ্রিল থেকে ‘সেবা সপ্তাহ’ কার্যক্রম পরিচালনা করে টিসিবি। সেই কার্যক্রমে গেল ৯ মে পর্যন্ত পণ্য বিক্রি করা হয়।

টিসিবি জানিয়েছে, রোববার থেকে আবারও দেশব্যাপী ৪০০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে চিনি, মসুর ডাল ও সয়াবিন তেল বিক্রি শুরু হয়। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ৮০টি, চট্টগ্রাম শহরে ২০টি ট্রাকে বিক্রয় কার্যক্রম চলবে। টিসিবির এবারের কার্যক্রম চলবে ১৭ জুলাই পর্যন্ত।

টিসিবি প্রতি কেজি চিনি ও মসুর ডাল বিক্রি করবে ৫৫ টাকা দরে। আর সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১০০ টাকা দরে বিক্রি করা হবে।

ক্রেতারা জানিয়েছেন সরকারের এই উদ্যোগ সারা দেশে সারা বছর চালু রাখা দরকার। তা না হলে নিম্ম আয়ের মানুষ তাদের চাহিদা মত পন্য কিনতে পারবে না। সেখানে দোকানে এক কেজি তেলের দাম ১৫৩ টাকা সেখানে এক কেজি সয়াবিন তেলের দাম মাত্র ১০০ টাকা। এছাড়াও ট্রাকে সেল হওয়া সব কয়টি পণ্যের দামই কম রয়েছে। আর এ কারণেই ট্রাকে দীর্ঘ লাইন থামছে না।

পেয়াজের দাম কিছুটা কমলেও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের লাইন কমছে না। এখনও দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে পেঁয়াজ সংগ্রহ করছে সাধারন মানুষ।

মরিয়ম বেগম বলেন, এমন লাইন ধরে চাল-ডাল কিনেছেন ২০০৮ সালের দিকে। তিনি যেখানে বসে ছিলেন, তাঁর উল্টো পাশেই একটি মাঠে বসত তৎকালীন বিডিআরের ন্যায্যমূল্যের দোকান। এরপর গত ১০ বছরে তাঁকে কখনো এভাবে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি।

রমজানের আগে মিল মালিকদের দাবি ছিল প্রতি লিটার ১৪৪ টাকা নির্ধারণের। তবে রমজান মাস বিবেচনায় তখন ব্যবসায়ীদের ধৈর্য ধরতে বলেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক কম। দাম না বাড়ালে ব্যবসায়ীরা নতুন করে এলসি খুলতে পারবে না। তাহলে সামনে কোরবানির ঈদে একটা সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাফর উদ্দিন বলেন, বিশ্ববাজারেও তেলের দাম নতুন করে বেড়েছে। সেই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে মন্ত্রণালয় তাদের (ব্যবসায়ীদের) প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। অচিরেই একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম প্রায় ১৬০ শতাংশ বেড়েছে। বিপরীতে দেশের বাজারে দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। সেই হিসাবে দেশের বাজারে আরেক ধাপে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা রয়েছে।

তিনি জানান, এক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫২ টাকা ১১ পয়সা; বর্তমানে সেই দাম ১৩৫ টাকা ৮৪ পয়সা। আর দেশীয় বাজারে সর্বশেষ মূল্য ১৩০ টাকা। এক বছর আগে দেশে ভোজ্য তেলের দাম ছিল ৮৮ থেকে ৯৩ টাকা।

ঢাকার কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকানগুলোতে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। আর খুচরা মুদি দোকানে তা বিক্রি হচ্ছিল প্রতি লিটার ১২০ টাকায়, প্রতিকেজি ১৩১ টাকায়। কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা মঈনুদ্দিন জানান, গত এক মাস ধরেই তেলের দাম লিটারে ১/২ টাকা করে উঠানামা করছে। পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জানান, দামের ওঠানামা আগামী দুই মাস চলবে বলে তার ধারণা। বর্তমানে মিলগেইটে সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১১৫ টাকা ৭০ পয়সা বা প্রতিকেজি ১২৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে লিটারে একটাকা করে বাড়লেও তা আবার কমেছে।

মোহাম্মদ আলী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার এখন ঊর্ধমুখী। সেপ্টেম্বরের দিকে আমেরিকার বাজারে নতুন মওসুমের সয়াবিন তেল আসবে। জুলাইয়ের দিকে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে পাম তেলের নতুন পণ্য আসবে। এই দুটি বাজারই ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। ২০২০ এর পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি দেখা হচ্ছে। সেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার ৯৫ ভাগেরও বেশি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিতে স্থানীয় বাজারেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে যেই পরিমাণে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, স্থানীয় বাজারে সেই পরিমাণে বাড়েনি। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের বাজার অস্থিতিশীল থাকায় মিল ও ভোক্তাস্বার্থ বিবেচনায় গত ফেব্রুয়ারিতে ভোজ্যতেলের মূল্য সীমা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং রমজান মাসে ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে গত ১০ এপ্রিল সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে ৪ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহার করে এনবিআর। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। উল্টো দাম বেড়েই চলছে। আর এ কারণেই সিটিবির ট্রাকে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন থাকছেই।

যেখানে ক্রেতাদের দাবি ট্রাকের পরিমাণ বাড়ানোর সেখানে আরও কমানো হয়েছে। আর এ কারনেই ট্রাকে ক্রেতার লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। সরকার বলছে আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু সাধারন ক্রেতার দাবি এ সেবা সারা বছরই সারা দেশে চালু রাখা দরকার।

https://dailysangram.com/post/455107