২১ মে ২০২১, শুক্রবার, ১:২৯

ব্যাংকিং খাতে বাড়তি করের বোঝা

বঞ্চিত বিনিয়োগকারীরা; প্রভিশন ও সিএসআর কার্যক্রমেও কর বহাল ; জাকাতকে ব্যয় হিসেবে দেখে না আয়কর আইন

ব্যাংকিং খাতের ওপর থেকে করের বোঝা কমছে না। পরিবর্তন হচ্ছে না কর্পোরেট ট্যাক্স অর্থাৎ সাড়ে ৩৭ শতাংশই বহাল থাকছে। বহাল থাকছে প্রভিশন ও সিএসআর কার্যক্রমের ওপর ট্যাক্স। ব্যাংকারোা জানিয়েছেন, নানা খাতের ওপর কর আরোপ করায় বছরে আয়ের প্রায় ৪৫ শতাংশই পরিশোধ করতে হয় নানা করে। একদিকে, ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে অর্থ এনে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। আবার এ প্রভিশনের ওপরও সরকার সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে কর দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, ব্যাংক খাতকে বাড়তি করের বোঝা বহন করতে গিয়ে জনসাধারণকে মাশুল দিতে হচ্ছে ঘাটে ঘাটে। ব্যাংকের ডিভিডেন্ড দেয়ার মতো প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এতে প্রাপ্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

ব্যাংকারোা জানান, নানাভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর করের খড়গ চাপানো হয়েছে। যেমন, ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে আয়ের ওপর জাকাত দিতে হয়। এ জাকাতকে ট্যাক্স আইনে ব্যয় হিসেবে ধরা হয় না। ফলে জাকাত দিতে গিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে জাকাতের পাশাপাশি সমহারে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এ দিকে সব শ্রেণীর আমানতকারীর মুনাফার ওপর অগ্রিম আয়কর কেটে রাখা হচ্ছে ১০ শতাংশ। আরকর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতকারীদের মুনাফার ওপর কর পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ।

কর্পোরেট ট্যাক্স সাড়ে ৩৭ শতাংশ : ব্যাংক বাদে অন্য কোনো লিমিটেড কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তাদেরকে কর্পোরেট ট্যাক্স দিতে হয় ৩৫ শতাংশ। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি না হলে ট্যাক্স দিতে হয় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। অথচ অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালনকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হলে মুনাফার ওপর কর্পোরেট ট্যাক্স দিতে হয় সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করলে ওই ব্যাংককে সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। আর তালিকাভুক্ত না হলে পরিশোধ করতে হয় ৪০ শতাংশ। তুলনামূলক বেশি হারে কর্পোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত আয় সরাসরি কমে যায়। এ কারণে অধিক হারে মুনাফা করতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং করে থাকে। নানা সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকের পকেট থেকে কেটে রাখা হয় বাড়তি অর্থ।

প্রভিশন ও সিএসআর কার্যক্রমেও কর : ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় গ্রাহকের স্বার্থরক্ষায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক সার্কুলারের কারণে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের প্রভিশনও বেশি পরিমাণ রাখতে গিয়ে প্রকৃত আয় কমে যায়। ব্যাংকারদের মতে, প্রভিশন ব্যাংকের বকেয়া ভিত্তিক অ্যাকাউন্ট হিসেবে স্থানান্তর করা হয়। আয়কর আইনে বকেয়া ভিত্তিক অ্যাকাউন্টের ওপর অর্জিত আয়ে কর রেয়াতের সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তা বকেয়া অর্থাৎ ব্যয় হিসেবে আয় কর আইনে গণ্য করা হয় না। ফলে একটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ১০০ কোটি টাকা হলে আর ওই ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ ৬৫ কোটি টাকা হলে প্রকৃত আয় নেগেটিভ অর্থাৎ লোকসান গুনতে হয়। কারণ ১০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফার ওপর সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। বাকি থাকে সাড়ে ৬২ কোটি টাকা। এখন প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে ৬৫ কোটি টাকা। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিট লোকসান হবে আড়াই কোটি টাকা।

এ দিকে, ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমকে বাংলাদেশ ব্যাংক অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সিএসআর কার্যক্রম উৎসাহিত করতে ব্যাংকের বার্ষিক অর্থনৈতিক মানদণ্ডের সূচকে (ক্যামেলস রেটিং) সিএসআরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যাংক যত বেশি সিএসআর কাজ করবে মানদণ্ডের সূচকে ওই ব্যাংক তত ভালো নম্বর পাবে। ব্যাংকারদের মতে, এ সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতাভুক্ত করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুধু তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে সিএসআর কার্যক্রম করলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধা দিচ্ছে। যেমন, ব্যাংক কোনো অন্ধকে আর্থিক সুবিধা দিলে তার ওপর কোনো ছাড় নেই। কিন্তু এনবিআরের তালিকাভুক্ত অন্ধদের কল্যাণে নিয়োজিত কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিলে তার ওপর কর সুবিধা পাচ্ছে। এর পরেও সাড়ে ৩২ শতাংশ সিএসআর কার্যক্রমে কর দিতে হচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, এতে দুই ধরনের অসুবিধা হচ্ছে। প্রথমত ব্যাংক সরাসরি প্রকৃত সুবিধাভোগীকে আর্থিক সহায়তা দিতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের সহায়তা করা হচ্ছে শতভাগ সুবিধা তারা পাচ্ছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতামুক্ত করায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক সিএসআর কার্যক্রম এড়িয়ে চলে।

জাকাতকে ব্যয় হিসেবে দেখে না আয় কর আইন : ইসলামী ব্যাংকগুলো শরিয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ায় ইসলামের ৫টি স্তম্ভের অন্যতম বাধ্যতামূলকভাবে জাকাত দিতে হয় ব্যাংকের আয়ের ওপর। ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রতি ১০০ টাকা আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ জাকাত দিতে হয়। কিন্তু জাকাতকে ব্যয় হিসেবে অর্থাৎ বকেয়া ভিত্তিক হিসেবে গণ্য করে না এনবিআর। এতে কোনো ব্যাংক ৫ কোটি টাকা জাকাত দিলেও সাড়ে ৩৭ শতাংশ হিসেবে ১ কোটি সাড়ে ৮৭ লাখ টাকা করও দিতে হয়।

মুনাফার ওপর কর দিতে হয় সাধারণ গ্রাহককে : যে সব আমানতকারীর টিআইএন নেই তাদের মুনাফায় থেকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর যাদের টিআইএন আছে তাদেরকে মুনাফায় ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আমানতকারীদের একটি বড় অংশের আমানত ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। করভার প্রত্যাহার না করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।

দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানান, ব্যাংকিং খাতের আমানতের একটি বড় অংশ আসে ৫ বছর থেকে ১০ বছর মেয়াদি সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে। তারা মাসে মাসে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার, ২ হাজার, ৩ হাজার টাকা বা তার ঊর্ধ্বে পর্যন্ত আমানত রাখেন। ৫ বছর বা ১০ বছর মেয়াদি এ আমানতের মেয়াদ শেষে বেশির ভাগ সঞ্চয়কারীকে ১ লাখ টাকা থেকে ২ লাখ টাকা বা তার বেশি পরিমাণ এককালীন পরিশোধ করা হয়। এতে একজন সাধারণ আমানতকারী কর দেয়ার মতো আয় না করলেও বাধ্যতামূলকভাবে কর দিতে হচ্ছে।

ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমছে, বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা : ব্যাংকের ওপর নানাবিধ কর আরোপের ফলে নিট আয় কমে যাচ্ছে। এতে যে হারে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের ওপর লভ্যাংশ পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি সাধারণের দুর্ভোগও বাড়ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকের ওপর যেকোনো ধরনের করারোপ করা হলে ব্যাংক তা নিজস্ব তহবিল থেকে পরিশোধ করে না। এক পর্যায়ে তা জনগণের ওপরই চাপিয়ে দেয়া হয়। যেমন, বিনিয়োগকারীদের নানা সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করতে হয়। সবধরনের গ্রাহকের ওপর নানা ধরনের বাড়তি সার্ভিস চার্জ চাপানো হয়। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত সাধারণ জনগণকেই মাশুল দিতে হয়।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/583100/