ফাইল ছবি
৫ মে ২০২১, বুধবার, ২:৩৯

সিলেটে ট্রাক নিয়ে মহাসড়কে আতঙ্ক

চলন্ত গাড়িতে নেশাচ্ছন্ন চোখে ছিল ঘুম ঘুম ভাব। তীব্র বেগে ইট বোঝাই ট্রাক চালাচ্ছিলেন মাসুক মিয়া। জৈন্তাপুরের দরবস্তে আসার পর ঘুমের মধ্যে গাড়ির কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেন তিনি। তীব্র গতির ট্রাক ঢুকে পড়ে পাশের দোকানে। আর ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে চার তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ঘটনার পর স্থানীয়রা আটক করেন চালক মাসুক মিয়াকে। তার বাড়ি সিলেটের জাফলংয়ে। ঢাকা থেকে লং জার্নি করে ফিরছিল সে।

দীর্ঘ জার্নি ও নেশার ঘোরে সে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি। আটকের পর প্রথমে স্থানীয় জনতা এবং পরে পুলিশের কাছে সে দুর্ঘটনা সময়কালীন ঘটনা জানিয়েছে। মাসুক জানিয়েছে, ‘সিলেট থেকে ছেড়ে আসার পর থেকে তার চোখে ঘুম ঘুম ভাব ছিল। এই অবস্থায় তিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন। দরবস্ত বাজারে আসামাত্র গাড়ির গতি ধরে রাখতে পারেননি।’ চালকের একটু ভুলে রোববার রাত দেড়টার দিকে দরবস্ত বাজারে মারা গেলেন চার তরুণ। এর মধ্যে তিনজন গাড়ির গ্যারেজের সামনে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়ানো ছিলেন। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, সরকার ঘোষিত লকডাউন চলছে। এই লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রাকে নিত্যপণ্য পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু রাত-বিরাতে সিলেটের রাজপথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ট্রাক। বিশেষ করে বালু ও পাথর পরিবহনে সিলেট-তামাবিল সড়কে রাতে শত শত ট্রাক চলাচল করে। আর এসব ট্রাকই এখন জৈন্তাপুরের মানুষের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা ট্রাকের নির্মমতায় একদিনেই সড়কে ৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। দুটি ঘটনাই ছিল মর্মান্তিক। দরবস্তের ঘটনায় চার তরুণের মৃত্যু হয়েছে। তাদের হারিয়ে কাঁদছে কানাইঘাটের চারটি পরিবার। রোববার ভোরে ঘটে আরেকটি ঘটনা। সিলেটের একটি হাসপাতালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান জৈন্তাপুরের রূপচেং গ্রামের জাকারিয়ার শ্যালক। সকালে ছিল তার জানাজা। মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ভোরে বাড়ি থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দরবস্ত যেতে সিএনজি অটোরিকশায় যাচ্ছিলেন জাকারিয়া। সারি ব্রিজের কাছে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়ের সামনেই দ্রুতগামী ট্রাকের চাপায় জাকারিয়ার চোখের সামনে মারা গেলেন পরিবারের চারজন। গুরুতর আহত হন জাকারিয়া। তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখন কিছুটা সুস্থ জাকারিয়া। তবে চোখের সামনে স্ত্রী ও দুই সন্তান সহ পরিবারের চার সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় তিনি পাগলপ্রায়। অবিরত বিলাপ করেই যাচ্ছেন। চোখে দেখা স্মৃতি ওলটপালট করে দিয়েছে সব। জাকারিয়া জানিয়েছেন, শ্যালক মারা যাওয়ার খবর শুনে রোববার সকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুটি অটোরিকশায় করে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। একটিতে তিনিসহ মোট সাতজন ছিলেন। অন্য অটোরিকশায় উঠেন তার ছোট ভাই ও অন্যরা।

সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে অটোরিকশাটি জৈন্তাপুর ফেরিঘাট এলাকায় সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে উঠার সময় সিলেট থেকে তামাবিলের দিকে যাওয়া একটি ট্রাক সজোরে সেটিকে ধাক্কা দেয়। এতে অটোরিকশাটিতে থাকা যাত্রীরা ছিটকে পড়েন। অটোরিকশাচালক সহ তিন যাত্রী ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হন। এরপর আর কিছু মনে নেই জাকারিয়ার। জ্ঞান ফেরার পর তিনি নিজেকে হাসপাতালের শয্যায় দেখতে পান এবং শুনতে পান- তার পরিবারের একসঙ্গে চার সদস্য মারা গেছেন। এরপর থেকে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি জাকারিয়া। জৈন্তাপুরের দুটি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে ট্রাক ও সিএনজি চালকদেরই। তাদের অসতর্কতার জন্যই একদিনে ৯টি প্রাণ চলে গেল। এ ছাড়া, চালক চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালনার কারণে দুর্ঘটনা দুটি ঘটেছে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ছিল গাড়ির গতি বেশি থাকা। জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর মানবজমিনকে জানিয়েছেন, চালকের ভুলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। দরবস্তের ঘটনার সময় চালক নেশাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল ধারণা করা হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত চলছে। চালককে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে তাকে পরবর্তীতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি জানান, সিলেট-তামাবিল সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি জৈন্তাপুর থানা পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। বিশেষ করে চালকদের সচেতন করার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হবে। সিলেট বিভাগ ও জেলা ট্রাক মালিক গ্রুপের সাংগঠনিক সম্পাদক শাব্বির আহমদ ফয়েজ জানিয়েছেন, লকডাউনে পাথর ও বালু বোঝাই ট্রাকের চলাচলও নিষেধ। কাদের শেল্টারে হাইওয়েতে এসব ট্রাক চলে সেটির তদন্ত দরকার। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে চালকদের সচেতন করার বিকল্প নেই বলে জানান তিনি। এ ছাড়া রাস্তায় স্প্রিড ব্রেকার ও অতিরিক্ত বাঁকের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি। পরপর দুটি দুর্ঘটনার পর উদ্যোগ নিয়েছেন স্থানীয়রা। সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে জৈন্তিয়া প্রবেশ গেইটে সচেতনতামূলক কর্মসূচি করেছে স্থানীয় যুবকরা। সোমবার রাত ১টা থেকে তারা জৈন্তিয়া প্রবেশ গেইট ঘাটেরচটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরি এলাকায় গাড়ি থামিয়ে প্রতি গাড়ির ড্রাইভারদের সতর্কতা অবলম্বন করে গাড়ি চালাতে পরামর্শ ও তাদেরকে চকলেট দিচ্ছে। পাশাপাশি যাদের চোখ দেখে ঘুমন্ত মনে হচ্ছে তাদের চোখ-মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের এমন উদ্যোগে প্রশংসা করছে স্থানীয় চিকনাগুল ইউনিয়নবাসী ও গাড়িচালকরা। এ সময়ে উপস্থিত ছিলেন জাহিদুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, আবু হুরায়রা, লুৎফর রহমান, জসিম উদ্দিন, শিপন, মুন্না, সেলিম, মিছবা, রুবেল, আশরাফ, হোসেন, সোহেল প্রমুখ।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=272896&cat=3