বিজয় সরণি এলাকায় পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ির কাগজপত্র চেক করছেন। ছবিটি গতকাল বৃহস্পতিবার তোলা -সংগ্রাম
১৬ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার, ৮:৫০

ঢাকার রাস্তায় বেড়েছে জন সমাগম

সরকারঘোষিত কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় দিন ছিল গতকাল বৃহস্পতিবার। প্রথম দিনের চেয়ে দ্বিতীয় দিন রাস্তায় পুলিশের অবস্থান তুলনামূলক কম দেখা গেছে। এদিন আগের দিন বুধবারের চেয়ে ঢাকার রাস্তায় মানুষের সমাগমও বেড়ে যায়। গতকাল সকালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ চেকপোস্টগুলোতে কিছুটা নমনীয় ভাব ছিল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, প্রথম দিন যেসব চেকপোস্টে পুলিশ বেশ কঠোর মনোভাব দেখিয়ে প্রায় প্রতিটি গাড়ি আটকে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, গতকাল তেমনটা দেখা যায়নি। তবে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ রাখা হয়। ফলে সব রাস্তায় চলাচল করতে পারেনি লোকজন।

লকডাউনের প্রথমদিন বুধবার পহেলা বৈশাখের ছুটি থাকায় সবকিছু বন্ধ ছিল। ফলে মানুষ ঘর থেকে কম বের হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার ব্যাংক, শেয়ারবাজার, পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা। ফলে সকাল থেকে রাস্তায় গাড়ি চলাচলও বেড়ে যায়।

সকাল সাতটা থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের দলে দলে তাদের কর্মস্থলে যেতে দেখা গেছে। শ্রমিকদের অনেকেই তাদের কারখানার আশপাশের এলাকায় বসবাস করায় তাদের পরিবহনের তেমন প্রয়োজন হয়নি। ফলে হেঁটেই কর্মস্থলের দিকে রওনা হন।

১৪ থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত সারাদেশে সব ধরনের অফিস ও গণপরিবহন, বাজার-শপিংমল, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ প্রভৃতি বন্ধ থাকবে। তবে জরুরি সেবার প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে। খোলা থাকবে শিল্প-কলকারাখা। সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবাও খোলা থাকবে। এই সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। খোলা স্থানে কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যদি কেনাবেচা করা যাবে ৬ ঘণ্টা। এর আগে ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বিধিনিষেধ দেয়া হলেও সেটি মোটেও কার্যকর হয়নি।

পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বুধবার থেকে কঠোর লকডাউন কার্যকর করতে সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা বাস্তবায়নে এবার কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা। কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে পুলিশের পক্ষ থেকে ‘মুভমেন্ট পাস’ নিয়ে বের হওয়ার নিয়ম চালু করা হয়। এর উদ্দেশ্য ‘অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রয়োজনীয়’ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা এবং জরুরি বিশেষ প্রয়োজনে যাতায়াতের সুবিধা রাখা।

বুধবার কঠোর লকডাউন শুরুর প্রথম দিন সকাল থেকেই রাজধানীজুড়ে কড়াকড়ি অবস্থা ছিল। সর্বাত্মক লকডাউনের প্রথমদিনে ঢাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলেও অলিগলিতে অনেককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। তাদের বেশিরভাগই বের হয়েছিলেন খুচরা জিনিসপত্র এবং কাঁচাবাজারের উদ্দেশে। কিন্তু লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে ঢাকার রাস্তায় মানুষের চলাচল বেশি দেখা গেছে। ব্যাংক ও পোশাক কারখানা খোলা থাকায় এই চলাচল বেড়েছে। তারা মুভমেন্ট পাস নিয়েই ঘর থেকে কাজে বেরিয়ে পড়েছেন।

পুলিশ বলছে, রাজধানীর বৃহত্তর পাইকারি কাঁচাবাজার হওয়ায় কারওয়ান বাজার এলাকায় লোকসমাগম বেশি হয়। তবে মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে বাইরে আসা মানুষদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে বিধিনিষেধের প্রথমদিন রাজধানী অনেকটা ফাঁকা থাকলেও দ্বিতীয় দিনে বেড়ে যায় সাধারণ মানুষ ও ব্যক্তিগত গাড়ি। মুভমেন্ট পাস নিয়ে এসব গাড়ি ব্যবহারকারীরা আবার আটকাও পড়ছেন স্থানে স্থানে। দিনের প্রথমভাগেই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে ‘কার্যত লকডাউনের’ ঢাকায়।

প্রাইভেটকারের আধিক্য : গতকাল রাজধানী ঢাকার প্রগতি সরণি, বিজয় সরণি, আগারগাঁও, গুলশান-তেজগাঁও সংযোগ সড়ক, ধানমন্ডি, মিরপুর রোডসহ বিভিন্ন স্থানে চেক পোস্টে পুলিশের তৎপরতায় গাড়ির দীর্ঘ সারি দেখা দেয়। বিভিন্ন গাড়ির সারির মধ্যে প্রাইভেট কারই ছিল বেশি। প্রগতি সরণির বাড্ডামুখী লেনেই গাড়ির সারি ছিল সকাল আটটা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। এই গাড়ির সারির মধ্যে প্রাইভেট কারই ছিল সিংহভাগ। নর্দা পদাচারী সেতুর কাছে প্রাইভেট কারের এত আধিক্য দেখে পথচারী সাইফুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় কত প্রাইভেট কার আছে, এখন বোঝা যাচ্ছে।

রাজধানীর প্রগতি সরণির কোকাকোলা এলাকায় পুলিশের চেকপোস্টে চেকিংয়ের ফলে গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার পর থেকে যাটজট শুরু হয়। তা চলে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। যানজট ছাড়িয়ে যায় কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত। গাড়ির দীর্ঘ সারিতে অধিকাংশই ছিল ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার)। এছাড়া কিছু স্টাফ বাস এবং মালবাহী লরি ছিল। ছিল ৪-৫টি অ্যাম্বুলেন্সও।

বিমান বন্দর সড়কের জসীমউদ্দিন রোডের মোড়, কাওলা, কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে গাড়ির সারি ছিল। কুর্মিটোলা হাসপাতালের বিপরীতে বসানো চেকপোস্টেও গাড়ির দীর্ঘ সারি তৈরি হয়। সেখানে অ্যাম্বুলেন্সে রোগীরা আটকা পড়েন, প্রাইভেট কারে জরুরি সেবার কর্মীরাও আটকা পড়েন। সকাল আটটায় ৬০ ফিট সড়কের স্থানে স্থানে প্রাইভেট কারের জট ছিল। বিজয় সরণির উড়োজাহাজ মোড়ে যানজট ছিল। এখানে আশপাশে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের জন্য সড়ক সঙ্কুচিত থাকায় জটে আটকা পড়ে একের পর এক গাড়ি। তার মধ্যে প্রাইভেট কারের আধিক্য ছিল।

আমার কি দোষ ?

আরজ আলী। পেশায় রিকশাচালক। সংসারে পাঁচ সদস্য। দিন কামান, দিন খান। গত ৮-১০ দিন ইনকাম নাই। তার বক্তব্য হলো-- সকালে বের হইছি। লোকজন নেই, ক্ষ্যাপও কম। একটা ক্ষ্যাপ নিয়ে দৈনিক বাংলা আইছি। ওখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে এখানে আসলাম। এখানে পুলিশ ধরে রিকশা উল্টা করে রেখেছে। এক ঘণ্টার শাস্তি। কী করবো বলেন? আমরা তো শখে বের হই নাই। আমাদের শাস্তি দিয়ে লাভ কী? আমাদের ব্যাংক ব্যালেন্স নাই। ঘরে খাবারও মজুদ নাই। গাড়ি না চালাইলে চলব কেমনে, খামু কী? আমাদের খাবার দেবে কে? এখন পুলিশ ছাড়লে গ্যারেজে গিয়ে রিকশা জমা দিতে হবে। কিন্তু ইনকাম হইছে ১০০ টাকা। ৫০ টাকা জমা দিলে থাকব ৫০ টাকা। পাঁচ জনের খাবার কেমনে চলবে? লকডাউনে আমরা কী করব?’

রিকশা উল্টো করে রাখায় বসে আছেন আরেক চালক মুনসুর বেপারী। ষাটোর্ধ্ব এ রিকশাচালক বলেন, ‘বয়স হইছে বলে কেউ কাজে নেয় না। তাই বাধ্য হয়ে রিকশা চালাই। মানিকনগর থেকে মতিঝিল যাত্রী নিয়ে আসলাম। নামিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ রিকশা ধরছে। আধা ঘণ্টা হইছে। কথা বললে শাস্তি বাড়ে। তাই চুপ করে বসে আছি। লকডাউনে রিকশা চালাইতে দিব না। কী করবো? সংসার চলবে কেমনে? খাবার দেন, ঘরে বসে থাকি। তা তো দিব না। গরীবের যত সমস্যা। বলে লাভ কী?’

ঢাকা ছাড়ছে মানুষ

কঠোর লকডাউনে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন। তারপরও পণ্যবাহী পরিবহন, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলে করে সাধারণ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, কিছু মানুষ প্রাইভেটকার বা মোটরসাইকেলের জন্য ঘোরাঘুরি করছেন। কয়েকটি মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার টার্মিনালে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ মোটরসাইকেলে চেপেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন।

গাবতলী থেকে আরিচা ফেরিঘাটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন সেলিম নামের এক যাত্রী। তিনি পাবনা যাবেন। গাড়ির জন্য দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে কয়েকজন মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে কথা বলেছেন। জনপ্রতি এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ করে ভাড়া চেয়েছেন বলে জানান তিনি। সাধারণ সময়ের চেয়ে ভাড়া অনেক বেশি চাওয়াতে তিনি যেতে পারছেন না।

গাবতলী এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ জানান, আমরা এখানে দায়িত্ব পালন করছি। কাউকেই সরকারের দেওয়া নির্দেশনা অমান্য করতে দেওয়া হচ্ছে না। কাউকেই মুভমেন্ট পাশ ছাড়া চলাচল করতে দিচ্ছি না। কিছু কিছু মোটরসাইকেল বা প্রাইভেটকারে করে মানুষ যাচ্ছে। তবে সেটা আমাদের চোখে পড়লে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছি।

https://dailysangram.com/post/449751