২৭ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১০:৪৪

দুই বোকা রাষ্ট্রনায়কের কথা

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী দূরে থাক, সামান্য কোনও অফিস বা সংস্থার সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হলেই অনেকে দাপুটে ভাব দেখান। “মুই কী হনুরে।” এমন হাবভাব দেখাতো যায়ই; খুব অল্প সময়ে এমনকি অনেককে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে শুধু কলাগাছ নয়, তালগাছও হতে দেখা যায়। বাড়ি-গাড়ি, বিরাট ব্যাংক ব্যালেন্স, এমনকি সুইজ ব্যাংকেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমানোর সৌভাগ্য অর্জন করে ফেলেন কেউ কেউ। আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে বাড়িঘরও তৈরি হয়ে যায় অনেক নেতা-নেত্রীর। বড় বড় নেতাদেরতো হয়ই। পাতি নেতাদেরও বাদ যায় না। এ জন্যই অনেক প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা হারিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। কারাবাস করতে হয়। এমনকি অনেক সময় বিদেশে নির্বাসনে যেতে হয় কোনও কোনও সাবেক প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে। এ ছাড়া মর্মান্তিক পরিস্থিতিরও শিকার হতে হয় কাউকে কাউকে। এমন ঘটনা ঘটেছে আমাদের আশপাশেই। তবে কোনও কোনও প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার মেয়াদশেষে অত্যন্ত মান-সম্মানের সঙ্গেও দেশে বেঁচে থাকেন। স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকেন। এমন দৃষ্টান্তও আছে পৃথিবীতে। তবে এঁদের সংখ্যা খুব কম।

আজ এমনই দুজন রাষ্ট্রনায়কের কথা উল্লেখ করতে চাই। এঁরা হলেন: আলাসানে দ্রামানে ওয়াত্তারা এবং মাহাথির মুহাম্মদ।
আলাসানে ওয়াত্তারা পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট। তিনি একবার নিয়ত করলেন পবিত্র হজ পালনের।
রাষ্ট্র বললো, প্রেসিডেন্ট হজে যাবেন। খয়খরচ সব দেবে রাষ্ট্র।
প্রেসিডেন্ট আলাসানে ওয়াত্তারা বেঁকে বসলেন। জানিয়ে দিলেন, রাষ্ট্রীয় খরচে তিনি হজে যাবেন না।
সৌদি আরব বললো, আপনি আমাদের অতিথি। আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করুন।
প্রেসিডেন্ট আলাসানে তাতেও রাজি হলেন না। বললেন, সম্পূর্ণ নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে একেবারে সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকে তিনি হজ পালন করবেন এবং তাই করলেন।
কিছুদিন আগে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেল, পবিত্র নগরী মক্কা আল মুকাররামার রাজপথে খানায়েকা'বার সম্মুখে উন্মুক্ত চত্বরে আইভরি কোস্টের মহামান্য প্রেসিডেন্ট আলাসানে দ্রামানে ওয়াত্তারা সাধারণ হাজিদের সঙ্গে শুয়ে আছেন। হজের সফরসঙ্গী কয়েকজন রাষ্ট্রীয় সেবক। তাঁরাও প্রেসিডেন্টের মতো।
অন্যজন আমাদের কাছের মানুষ। তাঁর পূর্বপুরুষেরা আমাদের আত্মীয়স্বজন চট্টগ্রামের মানুষ বলে প্রকাশ। তিনি হচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ।
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। মাহাথিরের হার্টে ব্লক ধরা পড়লো। ডাক্তাররা বললেন, এনজিওগ্রাম করে হার্টে রিং পরানো জরুরি।
মাহাথির বললেন, পরাও।
ডাক্তার বললেন, স্যার হার্টে রিং পরানোর জন্য বিদেশ যেতে হবে। কারণ তখন হার্টে রিং পরানোর মতো হাসপাতাল মালয়েশিয়ায় ছিল না।
বেঁকে বসলেন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবেন না। বললেন, আমি না হয় চিকিৎসার জন্য বিদেশ গেলাম। কিন্তু দেশের মানুষ? ওদের কি হবে? দেশে হাসপাতাল বানাও।
ডাক্তারদের জবাব: সময় লাগবে স্যার।
প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের স্পষ্ট ঘোষণা। বানাও হাসপাতাল। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও আমি অপেক্ষা করতে প্রস্তুত।

অতঃপর হাসপাতাল বানিয়ে যন্ত্রপাতি এনে সেট করতে সময় লেগে যায় প্রায় দুবছর। এরপর মাহাথিরের হৃদযন্ত্রে সফলভাবে রিং পরানো হয়। দুবছর মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষা করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ।
ভেবে দেখুনতো, আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট আলাসানে ওয়াত্তারা আর মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ কতটা বোকা!

কোথায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিশাল লটবহর নিয়ে রাজকীয় অতিথি হয়ে জমজমাট হজ করবেন, ঘন ঘন চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবেন, তা না করে দীনহীন ফকিরের বেশে হজ পালন আর নিজদেশে হাসপাতাল বানানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুবছর অপেক্ষা! স্বার্থপরতার মতো মহামারির যুগে কোনও দেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর এমন কাণ্ডকারবার মেনে নেয়া যায়? বোকা না হলে এরকম করে কেউ? পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নেতানেত্রীদের কাছ থেকে এঁদের কি কিছুই শিখবার নেই? আসলেই নেই। ভালো কিছু শিখতে এবং দৃষ্টান্তমূলক কিছু পৃথিবীতে রেখে যেতে হলে আলাসানে ওয়াত্তারা ও মাহাথির মুহাম্মদের মতো সফল এবং জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়কের কাছে শিখবার অনেক কিছু আছে।

দেশে দেশে রাষ্ট্রনায়ক হন। কেউ জনগণের ভোটে। কেউ আবার বিকল্প পথে। তবে সবাই জনগণ তথা দেশবাসীর ভালোবাসা অর্জন করতে পারেন না। ক্ষমতা ফুরোবার সঙ্গে সঙ্গে মান-মর্যাদা হারাতে হয় অনেককে। যারা ক্ষমতা গেলেও সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। মানুষের হৃদয়-আসনে জায়গা করে নিতে সক্ষম হন তাঁরাই ভাগ্যবান রাষ্ট্রনায়ক। আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট আলাসানে দ্রামানে ওয়াত্তারা এবং মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ অনেকের বিবেচনায় সহজ সরল বা বোকাসোকা হলেও দেশের নাগরিকদের কাছে গভীর ভালোবাসার পাত্র। সফল রাষ্ট্রনায়ক। দেশের মানুষের হৃদয়-আসনে ঠাঁই পাবার সৌভাগ্য তাঁরা অর্জন করেছেন।

https://dailysangram.com/post/447792