৪ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:৩১

কঙ্কাল সভ্যতা আর কতদূর

মানুষ সৃষ্টির সেরা, সুন্দরও বটে। আর নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় তো কবিদের আগ্রহের কোন কমতি নেই। নারীর এক তিলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ রাজা তো রাজ্য ছেড়ে দিতেও প্রস্তুত। মানুষের ভাবনার জগতে কত কিছুই না বিরাজ করে! তবে সব ভাবনাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক কিনা সেই প্রশ্নও আছে। আর কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। সব মানুষের বাস্তব জীবন আবার এক রকম নয়। মানুষের বেড়ে ওঠা এবং জীবনদর্শন পার্থক্য রেখা এঁকে দেয়। তবে জীবনের পরিণত আছে। এক জায়গায় সব মানুষের মধ্যেই মিল আছে। ধনী-গরিব, সাদা-কালো নির্বিশেষে সব মানুষকেই মরতে হয়। মরার পর সুন্দর মানুষের রূপটা কেমন হয়? কঙ্কাল দেখতে কেমন?

একটি হ্রদের নাম হয়েছে ‘কঙ্কাল হ্রদ’। ভারতের সর্বোচ্চ পর্বতমালার একটি ‘ত্রিশূল পর্বতমালা’। এটি ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত। ত্রিশূল পর্বতমালার শৃঙ্গে রয়েছে একটি হ্রদ। এই হ্রদে পাওয়া গেছে মানুষের শত শত কঙ্কাল! সেই থেকে এই হ্রদের নাম হয়েছে ‘কঙ্কাল হ্রদ’। তবে এই হ্রদের আসল নাম ‘রূপকুন্ড লেক’। কেমন বিপরীত বিষয়। একদিকে ‘রূপ’ অপরদিকে ‘কঙ্কাল’। বিপরীত বিষয়টি বাস্তবও বটে। সুন্দর মানুষটি মরার পর তো কঙ্কালই হয়ে যায়।

এখন হ্রদটি ‘কঙ্কাল হ্রদ’ নামেই বেশি পরিচিত। বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রূপকুণ্ড লেকটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ১৬ হাজার ফুট উপরে। হ্রদটির চারপাশে ও বরফের নিচে রয়েছে বহু কঙ্কাল। ১৯৪২ সালে কঙ্কাল হ্রদটি আবিষ্কার করেন টহলরত একজন বৃটিশ বনরক্ষী। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, হ্রদটি আবিষ্কারের পর অনেক বছর কেটে গেলেও কঙ্কালের রহস্যটি এখনও অজানা। বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে একাধিক গবেষণাও করেছেন। উল্লেখ্য যে, বছরের প্রায় পুরোটা সময় হ্রদের কঙ্কালগুলো বরফে ঢাকা থাকে। বরফ গলতে শুরু করলে ভেসে ওঠে কঙ্কালগুলো। এখন পর্যন্ত হ্রদটিতে প্রায় ৮শ’টি কঙ্কাল পাওয়া গেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এগুলো কাদের কঙ্কাল? পুরনো একটি তত্ত্ব মতে, কঙ্কালগুলো একজন ভারতীয় রাজা, তার স্ত্রী এবং সহযোগীদের। প্রায় ৮৭০ বছর আগে অতিরিক্ত বরফ পড়ার কারণে তাদের মৃত্যু হয়। আরেকটি তত্ত্ব বলছে, কঙ্কালগুলো ভারতীয় সেনাদের, যারা ১৮৪১ সালে তিব্বত আক্রমণের চেষ্টা করেছিলেন। আর একটি প্রচলিত ধারণা হলো, ওই হ্রদ একটি সমাধিস্থল। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষের কঙ্কাল ওই হ্রদে পাওয়া গেছে তাদের বেশির ভাগের উচ্চতা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি। অধিকাংশ মধ্যবয়সী, বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। কোন শিশু বা কিশোর নেই। মধ্যবয়সী কিছু নারী রয়েছেন। তারা সবাই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন।

ভারতের কঙ্কাল হ্রদ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, তত্ত্বও রচিত হয়েছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কঙ্কাল রহস্য উদঘাটন করা যায়নি। তবে মানুষ তিনটি তত্ত্বের সাথে পরিচিতি হয়েছে। একটি বিষয়ে তিনটি তত্ত্ব তো সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। একটি সঠিক হলে অন্য দুটি তো বেঠিক। অর্থাৎ মানুষের চিন্তা-ভাবনা বা গবেষণায় ভুলের মাত্রাই অধিক। আবার এমনও হতে পারে যে, প্রকৃত সত্য ওই তিন তত্ত্বেরও বাইরে রয়েছে, যেখানে গবেষকরা এখনও পৌঁছতে পারেন নি। মানুষ এক সময় কঙ্কাল হয়ে যাবে এ কথা ঠিক। তবুও মানুষ কঙ্কাল হতে চায় না। তাইতো মানুষ বলে, মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে।

মানুষ মরতে চায় না এ কথা ঠিক। বাঁচার জন্য মানুষের কত আকুতি, কত চেষ্টা-প্রচেষ্টা। ধনী-দরিদ্র সবাই যার যার মতো করে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কথাই ধরুন। এই মহামারি থেকে বাঁচার জন্য মানবজাতির কত প্রচেষ্টা, কত গবেষণা। তবে পরাশক্তি আমেরিকার সাবেক দাম্ভিক প্রেসিডেন্ট করোনাকে তেমন পাত্তা দিতে চাননি। করোনার টিকার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন উন্নাসিক। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে ভিন্ন কথা। ওয়াশিংটন থেকে এএফপি জানায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সাবেক ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছাড়ার আগেই গত জানুয়ারি মাসে চুপিচুপি করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তা প্রকাশ করা হয়নি। স্থানীয় সময় গত সোমবার ট্রাম্পের এক উপদেষ্টা একথা জানান। আসলে বাঁচার আকাক্সক্ষা সবারই আছে, আছে ট্রাম্পেরও। সহজে কি কোনো মানুষ কঙ্কাল হতে চায়? তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দায়িত্ব ছিল, মানুষের বাঁচার পথ সহজ ও সুন্দর করা। কিন্তু ক্ষমতার চার বছরে তিনি এই দায়িত্ব কতটা পালন করেছেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তাঁর আমলে তো পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধের দামামা প্রবল ছিল, নিজ দেশ আমেরিকাতেও তিনি শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ এবং উগ্রতাকে উৎসাহিত করেছেন। মার্কিন পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটলে সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারেও তাঁকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। ওই হামলায় তো পুলিশসহ কয়েকজন মানুষকে কঙ্কাল হতে হয়েছে। কোনো শাসক নিজের জীবনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতেই পারেন, কিন্তু নাগরিকদের জীবনকেও গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতে যদি তিনি ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁকে সুশাসক বলে কি অভিহিত করা যায়? বর্তমান সভ্যতায় যারা পরাশক্তি, তাঁদের ভাবভঙ্গিই আলাদা। তাঁরা উচ্চকণ্ঠে শান্তি-সংহতি ও মানবতার কথা বলবেন, আর বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও সম্পদ ব্যয় করবেন মারণাস্ত্রের পেছনে। মারণাস্ত্র তো মানুষকে বাঁচতে দেয় না বরং কঙ্কাল বানায়। পরাশক্তির দাম্ভিক নেতাদের সাধারণ মানুষের সুখ-দুখ নিয়ে ভাবার সময় থাকে না। বিশ্ব শান্তিতো দূরের কথা, নিজ দেশের সাধারণ মানুষও তাঁদের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমেরিকার চিত্রও একই রকম।

সাত বছরের শিশু লিজা স্কট। যুক্তরাষ্ট্রের আলবামা অঙ্গরাজ্যের হোমউডের বাসিন্দা সে। ছোট্ট এই শিশুকে হোমউডে স্যাভেজ বেকারির সামনে লেবুর শরবত বিক্রি করতে দেখা যায় সম্প্রতি। লিজা মস্তিষ্কের জটিল রোগে ভুগছে। এ থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার। এর জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গ্র্যান্ড ম্যাল সিজার নামক এক জটিল অসুখে ভুগছে সে। তিনটি অস্ত্রোপচার করতে হবে তার। এই অর্থের জোগান দিতেই লেবুর শরবত বিক্রি শুরু করে শিশুটি। লিজা স্কট বাঁচতে চায়। কেইবা চাইবে মরে কঙ্কাল হতে? যেমন চাননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাইতো চুপিচুপি তিনি স্ত্রীসহ নিয়েছেন করোনার টিকা। লিজার করুণ অবস্থা দেখে সামাজিকভাবে অনেকে এগিয়ে এসেছেন।

গণমাধ্যমেও ওকে নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ফলে লিজার চিকিৎসার অর্থ জোগাড় হয়ে গেছে। তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আমেরিকার মত দেশে সরকারি খরচেই শিশুটির চিকিৎসা হতে পারতো। শাসকরা হয়তো মারণাস্ত্রের পেছনেই অর্থ খরচে এখন বেশি আগ্রহী। তাই এদিকে নজর দিতে পারছেন না। প্রশ্ন জাগে, মানব সভ্যতা কি এখন কঙ্কাল-সভ্যতার দিকেই এগুচ্ছে?

https://dailysangram.com/post/445522