২৫ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১০:৪৫

বেপরোয়া চাল সিন্ডিকেট

পরিবহন সেক্টরের চেয়েও চাতাল মালিকরা শক্তিশালী কালো তালিকা করেও বন্ধ করা যায়নি ‘মজুতদারি’

ভারতসহ বিশ্বের বহু সমতল ভূমির দেশে বিস্ময়কর রেলযোগাযোগ গড়ে তুলেছে। সুযোগ থাকা সত্তে¡ও সড়ক পরিবহন সেক্টরের বাস মালিক শ্রমিকদের দাপটের কারণে বাংলাদেশে রেলযোগাযোগে সাফল্য আসেনি। পরিবহন সেক্টরের সিন্ডিকেট এতোই প্রভাবশালী যে সরকার তাদের হাতে যেন জিম্মি। যুগের পর যুগ ধরে সরকার পরিবহন সেক্টরের অবৈধ সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। বরং পরিবহন সেক্টরের হর্তাকর্তারা সরকারকে মাঝে মাঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দাবি আদায়ে বাধ্য করে থাকে। পরিবহন সেক্টরের সেই সিন্ডিকেটকেও হার মানিয়েছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। কারণে-অকারণে নানা অজুহাতে পণ্যে দাম বৃদ্ধি করে ক্রেতাদের বেশি দামে কিনতে বাধ্য করেন। বিশেষ করে চাল ব্যবসায়ী, চালকল মালিক ও চালের আড়তদারদের সিন্ডিকেট এতোই শক্তিশালী যে, তাদের কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

দেশের বাজারে হঠাৎ চালের দাম বেড়ে গেছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমদানির খবরেও কমছে না চালের দাম। উল্টো কেজিতে বেড়েছে এক থেকে দুই টাকা। পাইকারি আড়তদাররা বলছেন চাতাল মালিকরা দাম বাড়িয়েছেন। এদিকে এখনো বাজারে এসে পৌঁছায়নি আমদানি করা চাল। খাদ্য সচিব জানিয়েছেন আমদানি করা চাল বাজারে পৌঁছেতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে। বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন আমদানি করা চাল আসলেই দাম কমবে।

সংকটের অজুহাতে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকেই দেশের বাজারে চালের দাম বাড়তে থাকে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার চাল আমদানির অনুমতি দেয়। এ জন্য চাল আমদানিতে দুই দফায় সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ উদ্যোগের ফলে কমবে দাম। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে একদিকে যেমন আমদানি করা চাল দেশে পৌঁছেতে বিলম্ব হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন করে বেড়েছে দামও। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৮ টাকায়। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৮ টাকায়। নাজিশশাইল ৬৫ থেকে ৭২ টাকা আর মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়।

রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সবত্রই চালের দাম বেশি। ব্যবসায়ীরা চালকল মালিকদের উপর দায় চাপিয়ে বলছেন, চাতাল মালিকরা প্রতি বস্তা চাল ৫০ টাকা করে বাড়িয়েছে। আড়তের মালিকরা বলছেন ভারতের চাল এখনো প্রবেশ করেনি এই জন্য দামও কমেনি। অন্যদিকে পাইকার মালিকরা বলেন, ভারতে চাল যদি সঙ্গে সঙ্গে আসতো তাহলে আমরা কিছু কম দিয়ে কিনতে পারতাম। তারা তো ধান কিনে তার পর বাজারজাত করে।

২০১৬ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। অবৈধভাবে চাল মজুদ করায় ১৬ হাজার মিল মালিককে তিন বছরের জন্য ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করার ঘোষণা দেন তিনি। ঘোষণা দেন কালো তালিকাভুক্ত এসব মিলারদের কাছ থেকে আগামী তিন বছর সরকার চাল কিনবে না। বাজারে চালের দাম বাড়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যার পর থেকেই চাল মজুদ করেছিল। আমরা যে ক্রয়মূল্য (৩৪ টাকা) দিয়েছিলাম, বাজারের মূল্যের সঙ্গে বিরাট ফারাক ছিল। ফলে আমরা চাল সংগ্রহ করতে পারিনি। পরবর্তীতে আরো কয়েক দফায় চাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট অবৈধভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে দেয়ায় কয়েকশ’ মিলমালিক, চাতাল, ব্যবসায়ীকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। তাদের অসাধু চাল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকার কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে শোনা যায়নি। এমনকি অনেক চাতাল মালিক সরকারের কাছে নির্ধারিত মূল্যে চাল বিক্রি করতে অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখিয়েছে।

রাজধানীসহ ঢাকার বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানি শুরু হয়েছে। গতকাল বাজার ঘুরে দেখা গেছে প্রতি কেজি চালের বর্তমান দাম- মিনিকেট চাল : ৬২-৬৮ টাকা, আঠাশ চাল : ৫৪-৫৮ টাকা, নাজিশশাইল : ৬৫-৭২ টাকা, মোটা চাল : ৪৮-৫০ টাকা। পাইকারি আড়তদাররা বলছেন, তাদের কাছে এখনো আমদানি করা চাল এসে পৌঁছায়নি। বাড়তি দামের জন্য বেশি দামে চাল কেনা ও ধানের দাম বেশির অজুহাতও দিচ্ছেন তারা। চাল আমদানি ও সরবরাহে ক্ষেত্রে তৈরি হওয়া সব জটিলতাই নিরসন করা হচ্ছে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।

ব্যবসায়ীরা বলছেন আমদানি করা চাল ভোক্তাদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হয় তার ওপর এবং চাতাল মালিকদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে চালের দাম ওঠা নামা। বাস্তবতা হলো চালকল, চাতাল, চালের আড়তদারসহ চাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি সিন্ডিকেট তৈরি করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার নানা চেষ্টা করেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পরিবহন সেক্টরের সিন্ডিকেটের মতোই চাল সিন্ডিকেটের হাত অনেক লম্বা। তারা ক্ষমতাসীন দলের ছায়ায় থাকার কারণে সরকারের কোনো আদেশ নির্দেশনা ভ্রুক্ষেপ করছেন না। সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলতে না পারলে, দেশের কৃষকদের চাপে ফেলে যতই রফতানি করা হোক- চালের দাম কমানো যাবে না।

https://www.dailyinqilab.com/article/352794/