২১ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৩:৫০

টিকার সমন্বয় নিয়ে টানাটানি

এবার করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে সরকারের আন্ত মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার চিত্র মাথা তুলছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ভারত থেকে উপহারের যে ২০ লাখ ডোজ টিকা দেশে আসছে, এই টিকা দেওয়ার মূল কাজ কবে, কোথায়, কখন শুরু হবে, সে বিষয়ে দিনক্ষণসহ সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। মন্ত্রী, সচিবসহ দায়িত্বশীলদের একেকজন একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছেন গণমাধ্যমকে, এতে সৃষ্টি হচ্ছে বিভ্রান্তি। গতকালও সংশ্লিষ্ট তিনজন সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেও কেউই কবে টিকা দেওয়া শুরু হবে তা এককথায় নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি।

একই ধরনের সমন্বয়হীনতায় করোনা মহামারির শুরুর দিকে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল। সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিল সরকারকে। বিশেষ করে বিদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে আসা না আসা, ফ্লাইট চলা না চলা, কোয়ারেন্টিনের সময়সীমা, দেশের ভেতরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেড জোন ব্যবস্থা কার্যকর, মাস্কবিরোধী অভিযানসহ আরো কিছু ক্ষেত্রে ছিল বিশৃঙ্খল অবস্থা। সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় আসতে না আসতেই এখন টিকার প্রথম পর্যায়ের কর্মসূচি নিয়ে আবারও আন্ত মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার চিত্র সামনে এসেছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ গতকাল ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকার যেগুলো বাংলাদেশ কিনেছে, সেগুলোর চালান ২৫-২৬ জানুয়ারি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান একবার বলেছেন ২৫ জানুয়ারি, আবার বলেছেন ২৫-২৬ জানুয়ারি আসবে।

আর আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম নিজে এ বিষয়ে কোনো কথা না বলে মাইক্রোফোন ঠেলে দেন তাঁর পাশে বসা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলমের কাছে। মহাপরিচালকও ২৫-২৬ জানুয়ারির কথা বললেও পরক্ষণেই ড্রাই রানসহ আরো কিছু কর্মসূচির সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, টিকা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বিষয়ে এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিনি বরং আরেকটু অনিশ্চয়তার রেশ টেনে বলেন, ‘সব কিছু নিশ্চিত হওয়ার পরেও কিছু না কিছু অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। যেমন উপহারের টিকা বুধবার আসার কথা থাকলেও তা আসছে বৃহস্পতিবার, তেমনিভাবে আমরা এখন পর্যন্ত আশা করছি, ২৫-২৬ তারিখে আমাদের ক্রয়কৃত টিকার আওতায় প্রথম লটের ৫০ লাখ টিকা হাতে পাব। সেটা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কিছু ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হবে।’ এ সময় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নানও তাঁর কথায় সায় দেন।

তাঁদের এসব বক্তব্যের ঘণ্টাখানেক পরই এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (আজ) ভারত সরকারের উপহারের ২০ লাখ টিকার সঙ্গে একই চালানে কেনা আরো ১৫ লাখ ডোজ টিকা দেশে আসছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের কাছে এ রকম কোনো তথ্য নেই। পরে সন্ধ্যার দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি সংশোধন বিবৃতি পাঠিয়ে জানায়, এই ১৫ লাখ টিকা আসার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়।

শুধু তা-ই নয়, গতকাল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ওই ব্রিফিংয়ে নিশ্চিত করা হয়েছিল, আগের দিন জাতীয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে শাহজালাল বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষে টিকার চালান গ্রহণ করবেন। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমকে জানায়, টিকা গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা হবে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায়। এমন পরিস্থিতিতে আবারও সরকারের ভেতরে পারস্পরিক যোগাযোগ বা সমন্বয়হীনতার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

দুপুর ১টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যসচিব টিকা আসার পর কী কী করা হবে, সেই পরিকল্পনাগুলো বলার সময় সরকারকে টিকা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর বরাত দিয়ে ২৫ জানুয়ারি টিকা আসার বিষয়টি উল্লেখ করে কথা শুরু করেন। টিকা আসার পর কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টিকা দেশে আসার পর রাজধানীর কুর্মিটোলা বা যেকোনো একটি হাসপাতালে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্যাটাগরির ২০-২৫ জনের একটি টিমকে টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই টিকা উদ্বোধন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে ওই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন ও বক্তব্য দেবেন।’ কবে এই টিকা দেওয়া হবে, তা জানতে চাইলে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি স্বাস্থ্যসচিব। তবে তিনি বলেন, টিকা হাতে পাওয়ার পরে কর্মসূচি ঠিক হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘টিকা হাতে না পেয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে ফেললে কোনো কারণে ওই দিনক্ষণ ঠিক না থাকলে তখন তো আপনারাই সমালোচনা করবেন, তাই আমরা নিশ্চিত না হয়ে কর্মসূচির দিনক্ষণ ঠিক করতে চাই না। আমাদের প্রস্তুতি আছে, যখন-তখন এটা ঠিক করতে পারব।’

টিকা পেতে চাইলে আগে নিবন্ধন করতে হবে অ্যাপের মাধ্যমে। সে বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিটি সচিব এন এম জিয়াউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, অ্যাপটির ভেতরে এখনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অবহিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তবে এ জন্য একটি টিম কাজ করছে।

এদিকে টিকা এলেও এখনো চূড়ান্ত হয়নি টিকা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জাতীয় পরিকল্পনা। কবে চূড়ান্ত হবে, জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব কালের কণ্ঠকে বলেন, কাজ চলছে, কিছু কিছু সংযোজন-বিয়োজন হচ্ছে, হয়তো দু-এক দিনের মধ্যেই এটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/01/21/997113