১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ২:০২

পোস্ট-ই-সেন্টার প্রকল্প

৫৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে নয়ছয়

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনসাধারণকে ডিজিটাল সেবা দেয়ার নামে ৫৪১ কোটি টাকার প্রকল্পে হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। ‘পোস্ট-ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিনিউটি’- নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন ডাক বিভাগ। প্রকল্পটির সমাপ্তিকালে পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ডাক বিভাগের বর্তমান মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র। তখন তিনি বিভাগের উপ-মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্পে কেনা-কাটা থেকে শুরু করে ডিজিটাল পোস্ট সেন্টার স্থাপনসহ প্রকল্পের হেন কোনো স্থান নেই যেখানে অনিয়ম হয়নি। শুধু তাই নয়, বহু ডিজিটাল সেন্টার কাগজে থাকলেও অস্তিত্ব নেই, তবুও এসব সেন্টারের নাম দেখিয়ে বরাদ্দের টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের সত্যতার তথ্য উঠে এসেছে খোদ ডাক বিভাগের গঠিত দু’টি তদন্ত প্রতিবেদনে। মানবজমিন-এর হাতে আসা ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১২-১৭ এই পাঁচ বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫৪০.৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৮০.৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব পাওয়া গেছে।

বাকি ১৬০ কোটি টাকার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এই ব্যয় নিয়ে প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদনেও বলা হয়নি। শুধু তাই নয়, যে অর্থ এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে, যেসব জিনিসপত্র কেনা হয়েছে সেগুলোও নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ১৭০০ টি পওস মেশিনের মধ্যে মাত্র ৭০৪ টি মেশিন ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ ৯৫.৮৬% পওস মেশিন ব্যবহার হচ্ছে না। ফিঙ্গার ভেইন মেশিন ১০ হাজারটির মধ্যে মাত্র ৬৪৩ টি মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে । সেই হিসাবে ৯৩.৫৭% ফিঙ্গার ভেইন মেশিন ব্যবহার হচ্ছে না। যেসব ডিভাইসের মূল্য শতাধিক কোটি টাকা। জানা গেছে, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ থেকে পওস ও ফিঙ্গার ভেইন মেশিন কি কাজে ব্যবহার হয় এমন কোনো নির্দেশনা না দেয়ার কারণে ৫৪.৯৩ কোটি টাকার পওস মেশিন ও ১৯.৬২ কোটি টাকার ফিঙ্গার ভেইন মেশিন কোনো কাজে আসছে না।

জানা গেছে, প্রথমে প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন মো. আলাউদ্দিন। তিনি প্রথম দুই বছর এই দায়িত্ব পালন করলেও পরের তিন বছর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সুধাংশু শেখর ভদ্র। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, তিনিই এই পকল্পটি শেষ করেছেন। তিনি যখন ডাক বিভাগের উপ-মহাপরিচালক ছিলেন তখন তিনিই ছিলেন এই প্রকল্পের পরিচালক।

জানা গেছে, ৮৫০০ টি পোস্ট অফিস এই প্রকল্পের আওতায় থাকলেও নামে-বেনামে খরচ দেখিয়ে এই অর্থ লোপাট করেছেন প্রকল্প পরিচালক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার পাশের উপজেলা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় পাঁচটি ডাকঘরে কোনোটাই এই প্রকল্পের সুবিধায় আসেনি। অথচ প্রকল্প শেষ প্রতিবেদনে এসব নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাপাসিয়ার চরখামের ডাকঘর একটি কিন্তু নথিতে ব্যবহার করা হয়েছে দুই জায়গায়, এভাবেই এক স্থানের নাম অসংখ্য বার লিখে সাড়ে আট হাজার ডাকঘরের তালিকা পূর্ণ করা হয়।

শুধু তাই নয়, ডাক বিভাগের ২০১৫-১৬ সালে একটি নথিতে দেখা যায় কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে দেখানো হলেও খাতায় উল্লেখ নেই কি কেনা হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি গ্রহণ কমিটির কাছেও সুধাংশু ভদ্র ছিলেন আতঙ্ক। বিষয়টি নিয়ে ডাক অধিদপ্তরের প্রকৌশলী আনজির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ফাইলপত্র আমাদের কাছে কখনো দেয়নি। আমাদের কোনো গ্রহণ কমিটিতেও রাখেনি। তার এ বক্তব্যের রেকর্ড রয়েছে।

ডাক বিভাগের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পটি ডাক অধিদপ্তরের আওতায় ৪৮০০ টি পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বিভিন্ন রকম ডিজিটাল সেবা প্রদান করা। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প পরিচালক ও সংস্থার প্রধান কর্তৃক স্বাক্ষরতি প্রকল্প প্রতিবেদনে (পিসিআর) এর সংগ্রহ পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় ৫৪.৯৩ কোটি টাকায় ১৭০০০ টি পওস মেশিন, ১৯.৬২ কোটি টাকায় ১০,০০০ ফিঙ্গার ভেইন মেশিন, ১৪.৩৪ কোটি টাকায় ৮১০০ ফটো প্রিন্টার, ২.০৩ কোটি টাকায় ৩২৬ টি কম্পিউটার এবং একসেসরিজ, ১১.৫৭ কোটি টাকায় ৭২৫০ লেজার প্রিন্টার, ১০২.৩৪ কোটি টাকায় ২১০৪৫ টি দোয়েল ল্যাপটপ, ১৭.১১ কোটি টাকায় ৭৫১০ সেট ফার্নিচার, ৪৭.২৩ কোটি টাকায় ১৫০০ টি সোলার সিস্টেম, ৫.৩৬ কোটি টাকায় ১টি জিপসহ ১০টি ডবল কেবিন পিকাপ, ১৫.১১ কোটি টাকায় ইউপিএসসহ ৫০০টি সার্ভার, ৪.৪৭ কোটি টাকয় ৫০০ টি চিপ বেইজ কার্ড, ২.৭৩ কোটি টাকায় ৮২৭০ টি ওয়েব ক্যাম কেনা হয়।

এদিকে ভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের বেশির ভাগ ডিভাইস অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। শুধু তাই নয়, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পোস্ট মাস্টারদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ না দেয়ার ফলে এই প্রকল্পের ডিভাইসগুলো কোনো কাজে আসছে না।

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের ১৪ সংশোধিত অনুমোদিত প্রকল্পে ৫৪০.৯৪ কোটি টাকা কোটি দেখানো হলেও প্রকৃত ব্যায় হয়েছে ৩৮০.৬৫ কোটি টাকা। ১৬০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। অথচ পিসিআর এ সাশ্রয়ের বিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডাক অধিদপ্তরের ৪০৯ টি পওস মেশিন আইএসপিপি যত্ন প্রকল্পে হস্তান্তর করা হয়েছে। পওস মেশিন মূলত পোস্ট-ই- সেন্টারের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নগদ অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছিল। পোস্ট- ই-সেন্টারের আওতাধীন এলাকায় চলমান কোনো প্রকল্প কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী জনগণকে পওস মেশিনের মাধ্যমে সেবা প্রদান করার কথা। পওস মেশিনগুলো পোস্ট-ই-সেন্টারের স্থায়ী সম্পদ। এই সম্পদের আংশিক আইএসপি যত্ন প্রকল্পে দেয়া হয়েছে। এটা কতটা যৌক্তিক-কার্যকরী তা পর্যালোচনার দাবি রাখে মন্তব্য করেন কমিটির সদস্যরা। তদন্ত কমিটির দুই সদস্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের উপসচিব প্রশাসন-২ মো. আমিনুল ইসলাম ও উপসচিব-২ সাজ্জাত হোসেন এবং যুগ্মপ্রধান এবং তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. মুসলেহ উদ্দীন স্বাক্ষরিত এই প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। তদন্তের বিষয়টি ওই কমিটির সদস্য সাজ্জাত হোসেন নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। ডাক বিভাগের মহাপরিচালক ও তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্রকে ফোন দেয়া হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এদিকে খোদ মন্ত্রণালয়ের গঠিত ২টি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বলছে প্রকল্পের দুর্নীতি হয়েছে সবখানে। এই বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার মানবজমিনকে বলেন, এই প্রকল্প ২০১৭ সালেই শেষ হয়েছে। তখন এই কাজের খবরদারি করার মতো তখনকার মন্ত্রী, সচিবরা ছিলেন। এরপরেও যখন প্রশ্ন উঠেছে তখন আমরা তদন্ত করার কথা বলেছি। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনের সর্বশেষ গন্তব্য মন্ত্রী। সেটা আমার কাছে এখনো আসেনি। যদি তদন্ত প্রতিবেদন আসে, সেটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য, আমরা যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি কি-না। এ সবের উপর নির্ভর করে যদি দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=242634&cat=2