২৭ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:১৩

ক্ষতির মুখে শিক্ষার্থীরা

বর্তমান সরকারের বিগত ১১ বছরে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল একটি রুটিনে। বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া, নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শুরু, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষাসহ সকল পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হতো পূর্বনির্ধারিত সূচিতে। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস টালমাটাল করে দিয়েছে সব সূচিই। অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যের মতো শিক্ষা ব্যবস্থাতেও ব্যাপক আঘাত হেনেছে এই ভাইরাস।

করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্লাস-পরীক্ষা, স্থগিত রয়েছে চলতি বছরের এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা। এখনো করোনা সংক্রমণ চলমান থাকায় বাতিল করতে হয়েছে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষা। অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষাও নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। বার্ষিক পরীক্ষাগুলো নিয়েও এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না শিক্ষার দায়িত্বে থাকা দুই মন্ত্রণালয়।

তবে সবেচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা। অনেকেই ছুটিতে দেশে আসার পর এখন ফিরতে পারছেনা সেসব দেশে। আবার স্কলারশিপ পাওয়ার পরও বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে তারাও যেতে পারছেন না কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ৬০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যান। এবার নির্ধারিত সময়ে সেমিস্টারে যোগ দিতে না পারলে অনেকের ভর্তি বাতিলে সম্ভাবনাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্কলারশিপ পাওয়া শিক্ষার্থীরা। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও এখনো তাদের বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন তারা।

করোনা সংক্রমণের কারণে গোটা বিশ্ব যখন স্থবির তখন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করার বিকল্প ছিল না বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ঝুঁকির মধ্যে আমরা ফেলতে পারি না। বিশ্বের কয়েকটি দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর তা আবার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। তাই করোনা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত কোন ঝুঁকি নিতে চাইছে না সরকার।
অনেক দেশই এখন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ছুটি কাটিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরাও সেসব দেশে ছুটছেন শিক্ষা কার্যক্রমে যোগ দেওয়ার জন্য। পৃথিবীর অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেপ্টেম্বর থেকে নতুন সেমিস্টারও শুরু হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন বিদেশে শিক্ষা লাভের সুযোগ পাওয়া বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা। ছুটিতে দেশে আসা এবং নতুন ভর্তির সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। অনেকের বৃত্তি নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থী দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। সবচেয়ে বেশি যান মালয়েশিয়ায়। এরপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, ভারত, চীন ও জাপান। এ ছাড়া অন্য দেশেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। জানা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর সীমান্ত খুলে দেওয়ায় ৫৪টি দেশের নাগরিকেরা শেনজেন ভিসার সুবিধা ভোগ করবেন। তবে ওই তালিকায় নেই বাংলাদেশ। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। কত দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, টিউশন ফি বেড়ে যাবে কি না, সব নিয়ে ভাবতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

ইউনিভার্সিটি অব মিলানের শিক্ষার্থী কাওছার মাহমুদ ইতালিতে করোনা সংক্রমণ ব্যাপকার ধারণ করলে সেসময় দেশে ফিরে আসেন। তবে এতো দীর্ঘ সময় তাকে আটকা পড়তে হবে ভাবেননি। এর মধ্যে ইতালির জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে গেছে, সামার সেমিস্টারও শুরু হয়েছে। কাওছারও ইতালি ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট কান্ডে অক্টোবর পর্যন্ত ইতালিতে বাংলাদেশী নাগরিক প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন শিক্ষা কার্যক্রম কিভাবে সচল রাখবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। একই অবস্থা রোমের সাপিয়েঞ্জা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমরান হাসানের।

তারিন আহসান যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামায় এমবিএ পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। কথা ছিল জুনে যাবেন। কিন্তু সেটা পিছিয়ে সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়ার কথা। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি জমা দিতে বলা হয়েছে। ভর্তি ফিসহ আনুষঙ্গিক কাজে লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু তারিন বুঝতে পারছেন না, তিনি যেতে পারবেন কি না বা কীভাবে কী করবেন।

কানাডার মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউফাউন্ডল্যান্ডে স্নাতক স্তরে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তানভীর ইসলাম। সেপ্টেম্বরে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। ভিসা করাতে পারছেন না। ভিসা না করালে টিউশন ফিও দিতে পারবেন না। কবে যেতে পারবেন তা নিয়ে উদ্বেগে দিন কাটছে তার।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট: মার্চে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেশনজটে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইন প্লাটফর্মে ক্লাস শুরু করার নির্দেশনা দিলেও দু’একটি ছাড়া বেশিরভাগই শিক্ষার্থীদের ডিভাইস স্বল্পতার অজুহাতে এই পদ্ধতিতে ক্লাস শুরু করতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের ডিভাইসের জন্য শিক্ষার্থীদের তালিকা চাওয়া হলেও এখনো তা জমা পড়েনি ইউজিসিতে। ফলে এই সেশনজট আরও দীর্ঘ হবে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।

বাতিল পঞ্চম, অষ্টমের সিদ্ধান্ত আজ: করোনাপরিস্থিতিতে চলতি বছরের পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করেছে সরকার। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এই অবস্থায় প্রাথমিক সমাপনীর জন্য বিকল্প ৫টি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। এরপর তিনি তা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন করেন।

অষ্টম শ্রেণির জেএসসি এবং জেডিসির বিষয়ে আজ বৈঠকে বসবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এই পরীক্ষা নেয়া না নেয়া উভয় পক্ষে মতামত ও যুক্তি দিয়েছেন সিলেবাস বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার বৈঠকে প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে।

সিলেবাস শেষ না করেই পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত: প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত সিলেবাস পড়িয়ে, একাধিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে হয়। শিক্ষকদের তথ্য অনুযায়ী- এবার মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় সিলেবাসের ১০-১৫ শতাংশ পড়ানো হয়েছি। এরপরই প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অনলাইনে যে ক্লাস হচ্ছে সেখানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী হচ্ছে না। আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় ১০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থীকে এই কার্যক্রমে যুক্তই করতে পারেনি সরকার। ফলে বছরের শেষ দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না হলে সিলেবাস না পড়িয়েই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে পরবর্তী ক্লাসে উর্ত্তীর্ণ করতে হবে। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই শিক্ষাজীবনের একটি শ্রেণির পাঠ্য না পড়ে-না বুঝেই উঠবে পরবর্তী ক্লাসে।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, করোনায় শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এটা ঠিক। তবে তাদের ক্ষতি কিভাবে কমানো যায় সেজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করছি শেষ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারলে, বন্ধের দিনেও ক্লাস নিয়ে এবং পরবর্তী ক্লাসে উন্নীত হওয়ার জন্য যতটুকু সিলেবাস না পড়ালেই নয়, সেটি পড়িয়ে উন্নীত করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে সার্বিক পরিবেশের উপর।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, আমরা জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিকে (নেপ) তিনটি বিকল্প পাঠ পরিকল্পনা করতে বলেছিলাম। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসের জন্য তিনটি পরিকল্পনা করতে বলা হয়েছিল। যেহেতু সেপ্টেম্বরে এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি তাই সেপ্টেম্বরকে বিকল্প হিসেবে ধরছি না। অক্টোবর এবং নভেম্বরকে সামনে রেখে যে পাঠ পরিকল্পনা করেছি সেটাকে সামনে রেখে, সেটার ভিত্তিতে প্রত্যেকটা স্কুল ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র করে পরীক্ষা নেবে।

এদিকে এখনো স্থগিত চলতি বছরের এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা। গত এপ্রিলে এই পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও কবে হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি ও এপ্রিলে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। অথচ এই বছরের বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে সিলেবাস শেষ করা এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করা নিয়েও দুশ্চিন্তায় এসব শিক্ষার্থী।

সার্বিক বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া এবং পরীক্ষা গ্রহণ করার মতো পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। আমরা তো খুলে দেয়ার জন্য আন্তরিক। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে খুলে দিয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাই না। যখনই আমরা বুঝবো পরিবেশ স্বাভাবিক হয়েছে তার ১৫ দিনের মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে এবং এইচএসসি পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে।

শিক্ষার্থীরা ক্ষতির মুখে পড়েছে এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, করোনা কারো নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই এই অবস্থায় আগে জীবন বাঁচাতে হবে, সুস্থ্য থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ ক্লাস-পরীক্ষার কথা চিন্তা করেনি। এখন আমরা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি।

https://www.dailyinqilab.com/article/317466