২৫ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার, ১১:৪২

পোশাক রফতানিতে বিশ্ব বাজারে দ্বিতীয় অবস্থান হারিয়েছে বাংলাদেশ

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পোশাক রফতানিতে বিশ্ব বাজারে দ্বিতীয় অবস্থান হারিয়েছে বাংলাদেশ। একই সময়ে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি রফতানি করেছে ভিয়েতনাম, তারাই এখন পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। খাত সংশ্লিষ্টদের কারও কারও শঙ্কা, বছর শেষেও হয়তো তৃতীয় স্থানেই থাকতে হতে পারে বাংলাদেশকে। তবে বেশিরভাগ উদ্যোক্তার প্রত্যাশা, ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাসের অভিঘাতসহ নানামুখী প্রভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে তারা বলছেন, বছর শেষে অন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থান পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। আগের অবস্থান ফিরে পেতে প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আরও বেশি সক্ষমতা বাড়ানোর পরমর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বে পোশাক রফতানিতে চীনের অবস্থান প্রথম। কয়েক দশক ধরেই বাংলাদেশ রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। গেল কয়েক বছর ধরে তৃতীয় স্থানটি দখল করে রেখেছিল ভিয়েতনাম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি খুব দ্রুত এগিয়ে আসছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে রফতানি আয়ের ব্যবধানও কমছিল ক্রমেই। করেনাভাইরাসের সময়ে দেশের পোশাক কারখানাগুলো একের পর এক ক্রয়াদেশ হারালে রফতানি কমে যায় বাংলাদেশের। এই সুযোগেই বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে ভিয়েতনাম। তবে বছর শেষে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) যে তথ্য প্রকাশ করে, তার ওপর নির্ভর করেই রফতানিতে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থান নির্ধারিত হয়। সেই হিসাবে এখনো বাংলাদেশ এই খাতে দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে।

ডব্লিউটিও’র তথ্য অনুযায়ী, প্রথম অবস্থানে থাকা চীন ২০১৯ সালে বিশ্ব বাজারে পোশাক রফতানি করেছিল ১৫১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের। ৩৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করে দ্বিতীয় অবস্থান পায় বাংলাদেশ। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল ৩০ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের।

এদিকে, দেশের পোশাক খাতের সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে ভিয়েতনামের রফতানি ছিল ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সময়টিতে বাংলাদেশকে পেরিয়ে যায় ভিয়েতনাম।

এই তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জানুয়ারিতে বাংলাদেশের রফতানি আয় ৩ ছিল হাজার ৩৯ মিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের ২ হাজার ৪৭০ মিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের আয় ছিল ২ হাজার ৭৮৪ মিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের ২ হাজার ২২৩ মিলিয়ন ডলার। মার্চে বাংলাদেশের আয় ছিল ২ হাজার ২৫৬ মিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের আয় ২ হাজার ৩৩৮ মিলিয়ন ডলার। বছরের প্রথম একক মাস হিসেবে করোনাকালীন এই মার্চে এসে রফতানি আয়ে প্রথমবারের মতো ভিয়েতনাম ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশকে। পরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের রফতানি তলানিতে ঠেকে। মাসটিতে বাংলাদেশ মাত্র ৩৭৪ মিলিয়ন ডলারের আয় করে, বিপরীতে ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল ১ হাজার ৬০৯ মিলিয়ন ডলার। আর মে মাসে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়ে ১ হাজার ২৩০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল আরও বেশি ১ হাজার ৮৬৬ মিলিয়ন ডলার।

একটি সূত্রের তথ্য বলছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাস, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের আয় ছিল ১১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অন্য আরেকটি সূত্র বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ১২ মাসে তৈরি পোশাক খাত থেকে ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল ৩০ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। সেখানে একই সময়ে বাংলাদেশের আয় ছিল ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে গত অর্থ বছরে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম প্রায় ৩ বিলিয়ন (২৯৬ কোটি ডলার) ডলার বেশি আয় করেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, গত জুন পর্যন্ত ভিয়েতনাম রফতানি আয়ে আমাদের থেকে এগিয়ে আছে। কারণ করোনার সময়েও ওদের এখানে কারখানা চালু ছিল। বিপরীতে মার্চ ও এপ্রিল মাসে আমরা সর্বনিম্ন আয় করেছি। অনেক বায়ারই ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তবে জুন ও জুলাইয়ে আমাদের আয় ভালো হয়েছে। ছয় মাসে ওরা এগিয়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে আমরা পিছিয়ে গেছি। আমরা কাজ করছি। বছর শেষে আমরা আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারব।

জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র পরিচালক (শ্রম) রেজওয়ান সেলিম বলেন, করোনার সময়ে আমাদের রফতানি আয় যেমন কমেছে, তেমনি ভিয়েতনামেরও কমেছে। মার্চ এপ্রিলে আমাদের কাজ হয়নি। এছাড়া ঈদের ছুটি ছিল। আমাদের এখানে প্রায় এক থেকে দুই মাসের একটি বন্ধ ছিল। দুই মাসে প্রায় দুই বিলয়ন ডলারের রফতানি আয় আমাদের কমেছে। ওরা এখন ১ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার এগিয়ে আছে। এটি খুব একটি বড় পার্থক্য বলে মনে করি না। তবে বছর শেষে মনে হয় না আমরা আমাদের দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে পারব। হয়তো এই পার্থক্য এ বছর থেকেও যেতে পারে। আর সেপ্টেম্বর মাসটা গেলে বলা যাবে প্রকৃতপক্ষে ঘটনাগুলো কী ঘটছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে এই পরিচালক বলেন, আমাদের বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের রফতানি আয় খুব কম হয়েছে, তা বলা যাবে না। কারণ ওদের এখানে তেমন বন্ধ ছিল না। ইউরোপের চেয়ে বরং আমেরিকার বাজারে রফতানি তখন ভালো ছিল।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ভিয়েতনামের পোশাক খাতে চীন, জাপান ও কোরিয়ার বিনিয়োগ রয়েছে। আমাদের এখানে নিজস্ব বিনিয়োগকারী। এছাড়া ভিয়েতনাম কাঁচামাল ও প্রযুক্তিগত সুবিধায় রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে তারা কতটুকু এগিয়ে গেল, কতটুকু এগিয়ে যাবে এগুলো বলা যাবে আরও পরে। পৃথিবীতে এখনো করোনা রয়েছে। আমরা সাধারণ সময়ে ফিরে আসিনি। ফিরে এলে হয়তো আমরা আগের অবস্থানে দ্রুতই ফিরে আসব। আশা করি দ্রুতই আমরা আমাদের দ্বিতীয় অবস্থানে ফিরে আসব।

এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী জানান, ভিয়েতনাম এগিয়ে গেছে, আমরা ছয় মাসে তাদের নিচের অবস্থানে নেমে গেছি এ বিষয়গুলো আমার কাছে মুখ্য নয়। আমাদের মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হলো সক্ষমতা। ভিয়েতনাম এমনিতেই ভৌগলিক কারণে আমাদের চেয়ে এখন এগিয়ে রয়েছে। তাদের চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে যেমন সময় কম লাগছে, তেমিন রফতানিতেও সময় কম লাগছে। আমাদের ক্ষেত্রে সময় অনেক বেশি যাচ্ছে। এদিক থেকে ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে প্রাইস সক্ষমতায় রয়েছে। আবার ভিয়েতনামে চীনের অনেক যৌথ মূলধনী কোম্পানি রয়েছে। তারা দেখতেও অনেকটা চীনের মতো। এসব দিক থেকেও তারা সুবিধা পাচ্ছে।

তিনি বলেন, এছাড়া করোনায় আমাদের এখানে কারখানা বন্ধ ছিল। প্রচুর শ্রমঘন আমাদের এই শিল্প। হতাহত যদি আরও বেশি হতো, তাহলে এই শিল্পের জন্য আরও বড় দুর্ঘটনা বয়ে আনত। উদ্যোক্তাদের প্রশংসা করা উচিত এ কারণে যে তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা পরিচালানা করেছে। ফলে করোনায় এ খাতে আক্রান্ত ও হতাহত তেমনভাবে চোখে পড়েনি। সে কারণে ক্রেতারা আবারও ডিমান্ড দেখাচ্ছে। যেসব অর্ডার স্থগিত হয়েছিল, তার কিছু অংশ ফিরেও এসেছে। আর সরকারের প্রণোদনায় উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এখন প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আরও বেশি সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

https://dailysangram.com/post/425186