ফাইল ছবি
১০ আগস্ট ২০২০, সোমবার, ৯:১২

করোনার অ্যান্টিজেন পরীক্ষার অনুমোদন মিলছে না

উপেক্ষিত কমিটির সুপারিশ

স্বল্প ব্যয়ে ১০ থেকে ২০ মিনিটে টেস্ট করা সম্ভব * এ পদ্ধতি দ্রুত তৃণমূল পর্যায়ে নেয়া জরুরি * বারবার বলা সত্ত্বেও কেন অনুমোদন পাচ্ছে না বোধগম্য নয় -অধ্যাপক এম ইকবাল আর্সলান

দ্রুত করোনা শনাক্তে অ্যান্টিজেনভিত্তিক র‌্যাপিড ডায়াগনস্টিক টেস্টের (আরডিটি) অনুমোদন মিলছে না। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দেড় মাস আগে এ বিষয়ে সুপারিশ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি আলোর মুখ দেখেনি। ফলে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা পৌঁছায়নি।

এতে করোনার গতি-প্রকৃতি বোঝা যাচ্ছে না। ভাইরাসটির সার্বিক অবস্থা জানতে পর্যাপ্তসংখ্যক নমুনা পরীক্ষার জন্যই মূলত অ্যান্টিজেনভিত্তিক পরীক্ষার বিষয়ে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সুপারিশ করে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অ্যান্টিজেনভিত্তিক র‌্যাপিড ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ফল পেতে সময় লাগে ১০ থেকে ২০ মিনিট। এটি উচ্চমাত্রায় সংবেদনশীল। সাধারণ নমুনা পরীক্ষাগারেই এ পরীক্ষা করা সম্ভব। এমনকি পয়েন্ট অব কেয়ারেও এ ধরনের পরীক্ষা করা যায়।

দেশে এখনও অনুমতি দেয়া না হলেও পার্শ্ববর্তী ভারতে কোভিড-১৯ শনাক্তে এ পরীক্ষা বহুল ব্যবহৃত। তাদের মতে, যত দ্রুত সম্ভব এ ধরনের পরীক্ষার অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। কারণ রিয়াল টাইম আরটি পিসিআর পরীক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।

একবার পরীক্ষা শেষ করতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। আরটি পিসিআর বিটের দুষ্প্রাপ্যতা রয়েছে। যদিও কোভিড-১৯ শনাক্তে আরটি পিসিআর পরীক্ষা আমাদের দেশে অনুমোদিত এবং ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষায়িত পরীক্ষাগার ছাড়া এটি ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।

এমনকি এ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য উচ্চজ্ঞানসম্পন্ন কারিগরিভাবে দক্ষ শ্রমশক্তির প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারিগরি কমিটি সুপারিশ করলেও অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির হঠাৎ বদলি হওয়ায় এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ যারা অনুমোদন করবেন, তারা যদি বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে না পারেন তাহলে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়।

এছাড়া বর্তমানে যারা আরটি পিসিআর কিট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদেরও অদৃশ্য অবস্থান থেকে বাধা আসছে। কারণ এতে তাদের কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব কারণেই আটকে আছে আরডিটির অনুমোদন।

জানা গেছে, ৪ জুলাই কারিগরি পরামর্শক কমিটির ১৪তম সভায় জানানো হয়, ‘অ্যান্টিজেন বেজড কোভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমতির জন্য ঔষধ প্রশাসনকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, যাতে অতিসত্বর কোভিড-১৯ পরীক্ষার সুযোগ প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়।’

এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষার সম্প্রসারণ নীতিমালায় (খসড়া) অ্যান্টিজেনভিত্তিক রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়।

সেখানে বলা হয়, সার্স কোভ-২ ভাইরাসের নিউক্লিকি এসিডের বদলে জীবাণু-সংশ্লিষ্ট কোনো প্রোটিন (অ্যান্টিজেন) নির্ণয়ের মাধ্যমে সম্প্রতি কোভিড-১৯ নির্ণয়ের পদ্ধতি উদ্ভব হয়েছে।

বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনক্রমে এটি নানা দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইমিউনোযাসাই নামের একটি প্রযুক্তির নানা ধরন ব্যবহার করা হয়। যা ল্যাবরেটরির বাইরে ‘পয়েন্ট অব কেয়ার টেস্ট’ হিসেবে ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে ফলাফল পাওয়া যায়।

এজন্য এগুলোকে র‌্যাপিড ডায়াগনস্টিক টেস্ট বলা হয়। নিউক্লিকি এসিড অ্যামপ্লিফিকেশন টেস্ট বা ন্যাট পরীক্ষার মতোই এতে নাক-মুখের সোয়াব ব্যবহার করা হয়।

অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ৭ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষার নীতিমালার খসড়া প্রদান করা হয়। ৯ জুলাই তৎকালীন মহাপরিচালক কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালার খসড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন।

যার পরিপ্রেক্ষিতে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে জাতীয় পরামর্শক কমিটি, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটি, আইইডিসিআর প্রতিনিধি, নিপসম প্রতিনিধি, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের প্রতিনিধি এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের নমুনা পরীক্ষা সংক্রান্ত কমিটির প্রতিনিধির সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে মতামত প্রদানের নির্দেশনা দেয়া হয়। এ কমিটি ৪ আগস্ট স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে তাদের মতামতসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকরা বিষয়টি সার্বক্ষণিকভাবে দেখভাল করছেন।

অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে, স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা যুগান্তরকে বলেন, ১৮ আগস্ট এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী এ সভায় উপস্থিত থাকবেন।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া সরকার বাংলাদেশকে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বিষয়ে ৩ লাখ ডলার অনুদান প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যে অর্থ দিয়ে তাদের দেশে উৎপাদিত কোভিড-১৯ সংক্রান্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয় করতে পারবে অথবা টাকা নিতে পারবে।

কিন্তু এক মাস ধরে মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তিনি বলেন, অ্যান্টিজেন পরীক্ষা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বে যেসব অ্যান্টিজেন কিট রয়েছে তার মধ্যে কোরিয়ান কিট সবচেয়ে ভালো। যার সংবেশনশলীতা ৯৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে তাদের অনুদানের অর্থে আমরা অ্যান্টিজেন কিট আনতে পারি।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান যুগান্তরকে বলেন, অনেক আগেই অ্যান্টিজেন পদ্ধতিতে কোভিড-১৯ পরীক্ষা চালু করার পরামর্শ আমরা দিয়েছিলাম। এ পরীক্ষা করার জন্য বয়োসেফটি-টু (প্লাস) ল্যাবের কোনো প্রয়োজন হয় না।

এমনকি এটা ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট প্রযুক্তি জ্ঞানেরও প্রয়োজন হয় না। আরটি পিসিআরের তুলনায় দ্রুততম সময়ে রিপোর্ট দেয়া সম্ভব। এ পদ্ধতির পরীক্ষার ব্যয় পিসিআর পরীক্ষার তুলনায় অনেক কম।

বাংলাদেশে বৃহত্তর এলাকা এবং জনগোষ্ঠীকে সহজেই এ পদ্ধতিতে কোভিড-১৯ পরীক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হবে। এসব বিবেচনায় পরে স্বাস্থ্য অধিদফতর জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে পাঠানো হলে, সেখান থেকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।

সেই কমিটি বিষয়গুলো পরীক্ষা করে তাদের সুপারিশসহ নীতিমালা প্রদান করে। অধ্যাপক ইকবাল বলেন, আমি বুঝতে পারছি না, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি বারবার বলা সত্ত্বেও কেন র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা অনুমোদন পাচ্ছে না।

কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ল্যাবরেটরি এক্সপানশন পলিসি রিভিউ কমিটির আহ্বায়ক ৪ আগস্ট স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেন। সেখানে তিনি এর প্রয়োজনীয়তায় উল্লেখ করেন।

পাশাপাশি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন। যাতে এটি দ্রুত অনুমোদন দেয়া হয়। এতকিছু করার পরও অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছে না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/333289/