১০ আগস্ট ২০২০, সোমবার, ৯:১০

যেভাবে তুলে নিয়ে উখিয়ার বখতিয়ার মেম্বারকে হত্যা করেন ওসি প্রদীপ

লোমহর্ষক বর্ণনা স্ত্রীর

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সামাজিক শত্রুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ওসি প্রদীপ উখিয়ার কুতুপালং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তিন বারের নির্বাচিত সদস্য বখতিয়ার আহমদ মেম্বারকে গভীর রাতে ধরে নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ গল্প সাজিয়ে হত্যা করেন। এ সময় বাড়ি থেকে লুট করা হয় নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ অর্ধ কোটি টাকার মালামাল। বখতিয়ার মেম্বারকে ধরে নেয়ার বিবরণ দিয়ে তার স্ত্রী শাহিনা আকতার জানান, ২২ জুন রাত প্রায় পৌনে ৩টা। বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে। ঠিক ওই সময়ে বাড়ির দরজায় হাজির বরখাস্ত হয় ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। সাথে তার আরেক সহযোগী উখিয়ার ওসি মর্জিনা আক্তার। ‘বখতিয়ার ভাই, একটু বের হবেন! একজন মানুষকে শনাক্ত করতে হবে। আপনি চেনেন কি না!’ ওসি প্রদীপের এমন আহ্বানের পর একজন দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি হিসেবে বাড়ির দরজা খুলে দেন বখতিয়ার মেম্বার। বাড়ির দরজা খুলতেই ওসি প্রদীপ ও পুলিশ দল ছোঁ মেরে বখতিয়ার মেম্বারকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেন। দ্রুত গাড়িতে তুলে পুলিশ চলে যান তাদের গন্তব্যে। তখন বাড়িতে থাকা বখতিয়ার মেম্বারের তিন ছেলের মধ্যে মেজ ছেলে হেলাল উদ্দিন বাবার বিষয়টি জানতে ফোন দেন ওসি প্রদীপকে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ দু’বার ফোন রিসিভও করেছিলেন কিন্তু কথা বলেননি। পরদিন সকালে টেকনাফ থানাসহ উখিয়া ও কক্সবাজারের বেশ কয়েকটি থানায় খোঁজ নেন বখতিয়ার মেম্বারের ছেলে ও আত্মীয়-পরিজনরা। কিন্তু কোথাও বখতিয়ার মেম্বারের খোঁজ নেই। পরে বিকেলে খবর আসে বখতিয়ার মেম্বারকে টেকনাফ থানায় নেয়া হয়েছে। বাবার জন্য টেকনাফে ছুটে যান ছেলে হেলাল উদ্দিন। নানাজনের মাধ্যমে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দেনদরবার করেন। অনেকে আশ^স্তও করেন তাকে (বখতিয়ার মেম্বার) ছেড়ে দেয়া হবে। ওসি প্রদীপের হয়ে বিশাল অঙ্কের লেনদেনের প্রস্তাবও আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেনদেনের বিষয়ে বখতিয়ার মেম্বারের পরিবারের পক্ষ থেকে কনফার্ম কিছু না পাওয়ায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে একদল পুলিশ রাত ৮টার দিকে আবারো বখতিয়ার মেম্বারের বাড়িতে হানা দেয়। এবার বাড়িতে ঢুকেই বখতিয়ার মেম্বারের সহধর্মিণী শাহানা আক্তারের হাতে পরিয়ে দেন হাতকড়া। শুরু করা হয় মানসিক, শারীরিক নির্যাতন। সাথে অকথ্য গালিগালাজ। ওই সময় বখতিয়ার মেম্বারের কলেজ পড়–য়া মেয়ে ও দুই পুত্রবধূকে চড়থাপ্পড় ও শ্লীলতাহানি করেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও সাথে থাকা অন্য পুলিশরাও। লজ্জায় যে কথা কাউকে বলতে পারেননি তারা। তার পর বাড়ির আলমিরা ভেঙে লুট করা হয় স্বর্ণালঙ্কার ও ৫১ লাখ টাকা।

সাথে অসংখ্য জমির দলিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। ওই সময় বখতিয়ার মেম্বারকে পুলিশের সাথে আনা হলেও তাকে গাড়িতেই বসিয়ে রাখা হয়। বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট আর নারীদের শ্লীলতাহানির পর বখতিয়ার মেম্বারকে নিয়ে ফিরে যায় ওসি প্রদীপের পুলিশের দল। এই লুটপাটের পর বিশাল অঙ্কের টাকা দেয়ার প্রস্তাব আসতে থাকে পুলিশের পক্ষ থেকে। কিন্তু বখতিয়ার মেম্বারের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পায়নি পুলিশ। রাত তখন প্রায় আড়াইটা। বখতিয়ার মেম্বারের পরিবারের সদস্যদের কাছে মোবাইলে খবর আসে তাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হয়েছে।

ঠিক এভাবেই আলোচিত বখতিয়ার মেম্বারকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ‘হত্যা’র বিবরণ তুলে ধরেছেন তার সহধর্মিণী শাহানা আক্তার। পাঁচ সন্তানের এই জননী দাবি করেন, তার স্বামী বখতিয়ার মেম্বারের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা ছিল না। তিনি ইয়াবা কারবারেও জড়িত ছিলেন না। তিনি মূলত কুতুপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের ব্যবসায়িক কাজকর্ম করে দিনাতিপাত করতেন। শাহিনা আকতার বলেন, তার স্বামী স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ দুই বছর ধরে অসুস্থ ছিলেন। পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই কাটাতেন আর ধারাবাহিকভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

তিনি মনে করেন, তার স্বামী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সামাজিক শত্রুদের দ্বারা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। তাদের দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ দুই রাত ও এক দিন নির্যাতন চালিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে স্বামীকে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত ২৩ জুলাই রাত পৌনে ৩টার দিকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কুতুপালং এলাকার নিজের বাড়ি থেকে নিয়ে যান বখতিয়ার মেম্বারকে। পরদিন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সাজিয়ে বখতিয়ার মেম্বারের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মৌলভী বখতিয়ারের স্ত্রী শাহিনা আকতার আরো জানান, ওসি প্রদীপের হুমকি-ধমকিতে ভীত হয়ে এত দিন তারা মুখ খুলতে পারেননি। এমনকি হঠাৎ ক্রসফায়ারে স্বামীকে হারিয়েও তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে অবস্থান করতে পারছিলেন না। দিনে রাতে পুলিশসহ কোনো না কোনো বাহিনীর লোকজন এসে তাদের নানাভাবে হয়রানি করছে।

শাহানা জানান, তার স্বামীকে হত্যা করেই ওসি প্রদীপ নিজের অপকর্ম থামাননি। তার তিন ছেলেকেও ক্রসফায়ার, মাদক মামলাসহ তিনটি মামলায় আসামি করেছে প্রদীপ। স্ত্রী শাহিনা আকতারের তার স্বামী বখতিয়ার মেম্বারের ইয়াবা কিংবা মাদক মামলা তো দূরের কথা তার জীবনে অন্য কোনো মামলাও নেই। অথচ ওসি প্রদীপ কুমার তার স্বামীকে তুলে নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সাজিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছেন।

তিনি প্রশ্ন তুলেন, কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই একজন মানুষকে কিভাবে হত্যা করা যায়! বখতিয়ার মেম্বারের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। তাদের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আরেকজন কলেজে পড়েন। তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমে কর্মরত, মেজো ছেলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ছাত্র এবং ছোট ছেলে চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ছাত্র। বাবা বখতিয়ার মেম্বারকে হারানোর পরও ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ভয়ে-আতঙ্কে ওসি প্রদীপের গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত বাইরে রাত কাটাতে হয়েছে।

শুধু ছেলেমেয়েরা নয়, শাহিনা আকতার নিজেও পুলিশের ভয়ে আত্মীয়স্বজনের ঘরে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, এমন নির্যাতন পৃথিবীর কোথাও আছে কি না জানি না। আমার বিশ্বাস আল্লাহর পক্ষ থেকে ওসি প্রদীপের শাস্তি শুরু হয়েছে। তিনি একই সাথে উখিয়ার ওসিরও শাস্তি দাবি করেন। শাহিনা এখন তার স্বামী হত্যার উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং দায়ীদের বিচার চান।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/520533/