২৬ জুলাই ২০২০, রবিবার, ৩:৩৫

আস্থার সঙ্কটে স্বাস্থ্য খাত

হাসপাতাল ও ঠিকাদারদের ভয়াবহ দুর্নীতি; করোনার ভুয়া পরীক্ষা ও রিপোর্ট বাণিজ্য; অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা

আস্থার বড় সঙ্কটে পড়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাত। করোনা পরিস্থিতি স্বাস্থ্য খাতের বেহাল চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল, জেকেজি হেলথকেয়ার, রিজেন্ট হাসপাতাল, সাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালসহ বেশ কিছু নামকরা হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড জনগণকে ক্ষুব্ধ এবং সরকারকে বিব্রত করেছে। এদের উপর্যুপরি দুর্নীতি ও রোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া, করোনার ভুয়া পরীক্ষা ও পজিটিভ-নেগেটিভ বাণিজ্য, পিপিই ও মাস্ক সরবরাহ নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি, বেসরকারি হাসপাতালে ভুয়া ডাক্তারের ছড়াছড়ি, করোনা উপসর্গ নিয়ে ভুক্তভোগীরা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা না পাওয়া, দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে করোনা পরীক্ষা করাতে না পারা, হাসপাতালের সামনে রাতযাপন করেও সুচিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াসহ নানা কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর জনগণের এক রকম আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ব্যাপক সমন্বয়হীনতার চিত্র ফুটে উঠেছে। এই আস্থাহীনতার মধ্যে কিছু দিন আগে স্বাস্থ্যসচিবকে অন্যত্র বদলি করা হয়। এরপরই গত ২১ জুলাই দুর্নীতিসহ নানা কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি ডা: আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেন। মন্ত্রীরও অপসারণ বা পদত্যাগের জোরালো গুঞ্জনের ডালপালা মেলেছে। নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে অধিদফতরে নতুন ডিজি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ডাক্তার আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। নতুন ডিজি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে এই আস্থার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না তা নিয়েও বিশেষজ্ঞ মহলে নানা সংশয় রয়েছে। গতকাল নতুন ডিজি ডা: খুরশীদ আলম বলেছেন, দুর্নীতির দায় আমাদের সবার। স্বাস্থ্য খাতের এখন যে অবস্থা, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্নীতি রোধ করে ঘুরে দাঁড়ানোই আমার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের যে একটা সিন্ডিকেট আছে, ওই সিন্ডিকেটের সাথে সরকারের একেবারে স্পর্শকাতর যেসব লোকজন রয়েছেন তাদের অনেকের নাম উঠে এসেছে। এখন দরকার সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত ওই সব লোকজনের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা, তাদের অপসারণ করা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের নাম ছাইচাপা দিয়ে রাখা হচ্ছে। স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ও স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের অনেকের ধারণা, যেসব দেশের এজেন্ট এ দেশে আছে তারা আমাদের স্বাস্থ্যসেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য কাজ করে থাকে, যেন উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীরা পার্শ্ববর্তী দেশে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের হাত থাকতে পারে। বিদেশনির্ভর চিকিৎসাসেবাও স্বাস্থ্য খাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তিনি বলেন, যদি সরকার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন করতে চায়, সঙ্কট কাটিয়ে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চায় তাহলে বিদ্যমান সিন্ডিকেটকে ভাঙতে হবে, স্বাস্থ্য খাতের অভ্যন্তরীণ যে সমস্যা আছে তা সমাধান করতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মানুষের যে প্রশ্ন রয়েছে সেই সব প্রশ্ন দূর করতে হবে।

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, দুর্নীতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির পদত্যাগ আমাদের জন্য একটা মেসেজ। সরকার যেটা করতে পারে, তাহলো স্বাস্থ্য সেক্টরকে পুরো ঢেলে সাজাতে হবে। যেমন নি¤œস্তরের কর্মচারী থেকে শুরু করে ওপর মহলের সব পর্যায়ে পরিবর্তন আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, ডা: আবুল কালামের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যেন কোনোভাবেই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যেতে না পারে। তৃতীয়ত, স্বাচিপের একটি ভূমিকার কথা উঠে এসেছে। স্বাচিপকে স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। চতুর্থত, আস্থার যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে এ জন্য প্রয়োজনে অধিদফতরে মহাপরিচালক হিসেবে ডাক্তারদের নিয়োগ না দিয়ে আমলাকেন্দ্রিক প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আমরা দেখেছি, গত ১০ বছর এ খাত ডাক্তাররাই পরিচালনা করছেন, তারাই সব দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমলাদের দিলে খুব বেশি ভালো হয়তো হবে না। তবে মন্দের ভালো। বিকল্প নেই তো। তবে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার যেসব ডাক্তার আছেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার স্বার্থে তাদের স্বল্প সময়ের জন্য এখানে আনা যেতে পারে। ডাক্তারদের এখানে না রাখার কারণ হলো অধিদফতরে যেসব সিনিয়র ডাক্তার রয়েছেন উনারা সবাই অধ্যাপক, উনারা অনেক এক্সপার্ট। ফলে তাদের হাসপাতালেই থাকা উচিত। তাদের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারব। তারেক শামসুর রেহমান বলেন, শক্ত হাতে আমরা যদি দুর্নীতিটাকে উৎখাত করতে না পারি, সরকার যে জিরো টলারেন্সের কথা বলে এখনই যদি সেটা বাস্তবায়ন না করতে পারি তাহলে সরকারও বড় ধরনের আস্থার সঙ্কটে পড়ে যাবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরে নতুন ডিজি নিয়োগ দেয়া হয়েছে আশা করি তিনি আস্থার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবেন। যেসব সমস্যা রয়েছে তথ্য গোপন না করে তা নিয়ে মানুষের সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তদন্তসাপেক্ষে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এটা যদি ঢেলে সাজানো হয় তাহলে মানুষের মধ্যে যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা কেটে যাবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/517825