২২ জুলাই ২০২০, বুধবার, ১২:০৭

বিশুদ্ধ পানিতে ৮০ শতাংশ রোগ আর ২১ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমে

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউএনএফপিএর তথ্য

শুধুমাত্র বিশুদ্ধ খাবার পানির মাধ্যমে ৮০ শতাংশ রোগ এবং ২১ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দূষিত পানির কারণে দেশে মানুষের মধ্যে প্রাণঘাতী সংক্রামকরোগ দিন দিন বাড়ছে। মানুষ ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বলছে, পানি প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দূষিত পানি দীর্ঘদিন পান করলে আরো জটিল রোগ, এমনকি মারণব্যাধি ক্যান্সারও হতে পারে। কিডনি রোগ, আলসার, রক্তচাপ, অ্যাজমা, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের মাধ্যমে মানুষের দেহে ৮০ শতাংশ রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। কারণ স্বল্পমাত্রায় পানি সরবরাহ ও অপ্রতুল স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য মানুষের মধ্যে ৮০ শতাংশ রোগব্যাধি হয়ে থাকে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে প্রতি ৫ জনে ৩ জন নিরাপদ খাবার পানি পায় না। তাই বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা দিতে পারলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মকসব ব্যাধি থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

এ দিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় সবচেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন রাজধানীর মানুষ। নগরবাসীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ, ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে ফোটানো হলেও কিছু এলাকায় সরবরাহকৃত পানি থেকে দুর্গন্ধ যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহকৃত পানির ১৫ শতাংশ আসে সায়েদাবাদ পানিশোধনাগার থেকে। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানি শোধন করে তা নগরবাসীর জন্য সরবরাহ করা হয়। এর বেশির ভাগ পানি চরম ঝুঁকিপূর্ণ, এমনকি ফুটিয়ে, ফিল্টার করেও গন্ধমুক্ত করে খাওয়ার উপযোগী করা যায় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বছরে আড়াই কোটি মানুষ পানিবাহিত রোগের কারণে মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। মাঠপর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন ১০ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি রয়েছে। রাজধানীতে প্রতিদিন ২২০ থেকে ৩০০ কোটি লিটার পানি প্রয়োজন। গত তিন দশকে ভূগর্ভস্থ পানির জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা যায়নি। বর্তমানে সারা দেশে বছরে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ পানির সঙ্কটে ভুগছে।

আইসিডিডিআরবির ডায়রিয়া ডিজিজ ইউনিটের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: আজহারুল ইসলামের মতে, পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া রোধে বিশুদ্ধ পানির বিকল্প নেই। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে পানির চাহিদা অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী পানি না পেয়ে বেশির ভাগ মানুষই জীবাণুযুক্ত ও দূষিত পানি পান করেন। এই দূষিত পানির মাধ্যমেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি জন্ডিসের জীবাণুও ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের মল থেকে জীবাণুটির বিস্তার ঘটে। ফলে ডায়রিয়ার পাশাপাশি জন্ডিস, টাইফয়েড, আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। শিশু ও বয়স্ক মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকায় তারাই এসব রোগে বেশি আক্রান্ত হন।

অপর দিকে শহরের বাইরে অবস্থা আরো ভয়াবহ, সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে প্রতি বছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। তাই দেশে মানুষের প্রতিদিন সুপেয় পানির যে চাহিদা রয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সেই চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়। ভূগর্ভস্থ পানি না পাওয়ার কারণে মানুষকে ভূ-উপরিভাগের পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। গ্রামের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী বিকল্প হিসেবে নদ-নদী, পুকুর, খাল-বিলের পানির ওপর নির্ভরশীল। এসব পানি পান করে বিভিন্ন রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ।

এ ছাড়াও বিভিন্ন দূষিত পদার্থের প্রকট উপস্থিতির কারণে গভীর নলকূপের পানিও আর নিরাপদ নেই। এতে ভয়াবহ মাত্রায় ঢুকে পড়েছে পানিবাহিত রোগের উপাদান ব্যাকটেরিয়া। এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ পরিচালিত ওয়াটার কোয়ালিটি টেস্টিং ল্যাবরেটরির (ডব্লিউকিউটিএল) এক গবেষণায় দেশের অধিকাংশ নলকূপের পানিতে ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও ম্যাঙ্গানিজ নামের একটি ভারী ধাতুর উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এ ধাতুটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। গবেষকরা বলছেন, মাটির নিচে পানির স্তরে এই ধাতুর উপস্থিতির কারণে তা পানের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাভুক্ত আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা: মাহমুদুর রহমানের মতে, পানিতে মিশে থাকা কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসা, ক্যাডমিয়ামসহ বিভিন্ন দূষিত পদার্থ শুধু ফোটানোর মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়। পানিতে কোন পদার্থ মিশে আছে তা শনাক্ত করতে হবে। এরপর পৃথকভাবে পরিশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। জীবাণুভেদে পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য পৃথক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয়।

আইইডিসিআর ও সিডিসি প্রোগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি দূষিত হওয়ার কারণ অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার। এই কীটনাশকে নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস থাকে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তা মাটির ভেতরে পানিকে বিষাক্ত করে। শহরাঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে পানি দূষিত হওয়ার স্তরটি মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে। এতে করে পানি প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের ফলে আবাসিক এলাকা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা, পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। তেলের ট্যাংকার থেকেও প্রচুর ধাতু, তৈলাক্ত পদার্থ, সিসা, পারদ, দস্তা ও ক্রোমিয়ামের মতো বিষাক্ত দ্রব্য নদ-নদী ও সাগরের পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে। গত কয়েক বছর ধরে বস্ত্র শিল্প, চামড়া শিল্প, শোধনাগার, ছাপাখানা ও বড় শিল্পের তরল বর্জ্য দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য দিকে ভূপৃষ্ঠের পানি দূষণ সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়ে গ্রামের মানুষ যখন নলকূপের পানির ব্যবহার শুরু করে, তখনই তারা আর্সেনিকের শিকার হচ্ছে। এর বাইরে ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভারসহ নানা জটিল ও প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রফেসর ডা: আবুল কালাম আজাদ জানান, দূষিত পানি পানের কারণে হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস এমনকি মারণব্যাধি ক্যান্সারও হতে পারে। তাই বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে মারাত্মক অনেক রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।

অপর দিকে জাতিসঙ্ঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন পানি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পানিবাহিত রোগ এবং এ কারণে মৃত্যুঝুঁকি প্রায় ২১ শতাংশ পর্যন্ত কমানো যেতে পারে। এতে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রামাঞ্চলে শতকরা ৮৭ ভাগ মানুষের পানীয় ও সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। এ জন্য এসব দেশে প্রতি পাঁচটি রোগের মধ্যে চারটিই সৃষ্টি হয় বিশুদ্ধ পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব থেকে। তাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ২৫ হাজার মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/516906/