৪ জুলাই ২০২০, শনিবার, ৩:০৪

করোনাভাইরাসের ধাক্কা: ভোক্তার বাজেট কাটছাঁট

কেনাকাটা, বিনোদনসহ বিভিন্ন ব্যয়ে লাগাম প্রভাব পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়

ওয়াজেদ আলী দীপু একজন মাঝারি মানের ব্যবসায়ী। সব মিলে মাসিক আয় গড়ে ৩০ লাখ টাকা। রাজধানীর ফার্মগেটে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ভয়াবহ করোনাভাইরাসে তিন মাসে আয় শূন্যের কোঠায় নেমেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ভাড়া ও কর্মচারীর বেতন গুনতে গিয়ে পকেট থেকে টাকা দিচ্ছেন। আক্ষেপ করে যুগান্তরকে দীপু বলেন, আয় ও ব্যয়ের অসামঞ্জস্য হিসাব মেলাতে গিয়ে পারিবারিক বাজেটে কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অহেতুক কোনো ব্যয়, বিনোদন, কেনাকাটা সবই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এদিকে করোনার প্রাদুর্ভাবে গত তিন মাসে রাজধানীর হাজারীবাগের বাসিন্দা এনাম হোসেন সায়েমের আয় কমেছে ২৫ লাখ টাকা। টঙ্গী এলাকার মার্কেটের দোকান ভাড়াই আয়ের একমাত্র পথ। তার বড় ধরনের আয়ে ধস নামায় গেল ঈদে পরিবারের কাউকে নতুন পোশাক কিনে দেননি। হিমশিম খাচ্ছেন ব্যয় সামলাতে।

মাঝারি মানের ব্যবসায়ী দীপু ও সায়েমের মতো বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ীর অবস্থাই একই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনায় কর্মহীন সাড়ে তিন কোটি মানুষ। তাদের পুরো পারিবারিক ব্যয় কাটছাঁট করেই চলতে হচ্ছে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে টাকা খরচ করছে না এসব পরিবার। বিশেষ করে কমানো হচ্ছে পোশাক কেনাকাটা, বিনোদন ও ভ্রমণকেন্দ্রিক সব ধরনের ব্যয়। ভোক্তার এই ব্যয় কমানোর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের ওপর। কারণ এরই মধ্যে তাদের ৫০ শতাংশের বেশি ক্রেতা কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েছেন বিপুলসংখ্যক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। দুশ্চিন্তায় আছেন তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখা নিয়ে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি রেজাউল ইসলাম মন্টু যুগান্তরকে বলেন, ‘করোনা থেকে মন্দার ধারা চলে আসছে। এই ভাইরাস রং বদলে দিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের। করোনার থাবায় এমন হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কোনো ক্রেতা বের হচ্ছে না। সামনে কোরবানির ঈদ। এখন সবাই গরু নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। সরকার অর্থনীতিকে সক্রিয় করতে সম্প্রতি শপিংমল-বিপণিবিতান খোলা রাখার সময় বিকাল চারটা থেকে বাড়িয়ে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এতে খুব বেশি কাজ হবে না। ক্রেতা অর্ধেকের বেশি কমে গেছে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশব্যাপী প্রায় ২৫ লাখ দোকান রয়েছে। এসব দোকানের অধিকাংশ শপিংমল ও বিপণিবিতান। কিন্তু অধিকাংশ দোকানিই হতাশ। তারা বলছেন ক্রেতা নেই, বিক্রিও নেই। ঢাকার বাইরে একই অবস্থা বিরাজ করছে।

উত্তরের সীমান্ত জেলা দিনাজপুরে শহরের শপিংগুলোতে কোনো ভিড় নেই ক্রেতার। অনেকটা হতাশ সময়ে পড়েছে এখানে দোকানিরা। করোনার কারণে এখানে মানুষ আসছে না কেনাকাটা করতে। জানতে চাইলে দিনাজপুর জেলা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দিনাজপুর গুলশান মার্কেটের সভাপতি জহির শাহ যুগান্তরকে বলেন, শপিংমল ও দোকানগুলোতে ৫০ শতাংশ ক্রেতা নেই। নেহাত প্রয়োজন ছাড়া কোনো ক্রেতা মার্কেটে আসছে না। পরিস্থিতি ভালো না হলে ক্রেতারা বাসাবাড়ি থেকে বের হবে না।

এদিকে ছোট-বড় মিলে প্রায় ১৬৮টি শপিংমল রয়েছে রংপুরে। দোকানের সংখ্যা ৪০ হাজার। বন্যা ও মন্দাকবলিত এ অঞ্চলে দিন দিন চাহিদার কারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শপিংমলগুলো। কিন্তু সে চরিত্র এখন নেই। প্রয়োজন ছাড়া ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শপিংমলগুলোতে। জানতে চাইলে রংপুর মহানগর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন যুগান্তরকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে মানুষ একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না। মার্কেটেও আসছে না।

জানা গেছে, মূলত নিু ও মধ্যবিত্তদের পারিবারিক বাজেট কাটছাঁট ও স্বাস্থ্যঝুঁকি এই দু’কারণে ক্রেতারা এখন মার্কেট, শপিংমলমুখী হচ্ছে না। মতিঝিলের বাসিন্দা জাকির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য শূন্যে নেমেছে। নিজের পরিবারে প্রয়োজনের বাইরে কোনো ব্যয় করা হচ্ছে না। আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ঝাউচরে বসবাসকারী চাকরি জাহাঙ্গীর জানান, শিশুদের খাবারে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু দিতে হচ্ছে। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের সব ধরনের ব্যয় কাটছাঁট করেই সংসার চালানো হচ্ছে। এই মুহূর্তে পোশাকের বাজারে যাওয়ার মতো মানসিকতা নেই।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/322400/