২৩ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:৫৬

মৎস্য উৎপাদন কমেছে বছরে ১০ হাজার টন

মাথাপিছু চাহিদায় বাড়তি ৫ লাখ টন উৎপাদন দরকার; প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট বাধায় উৎপাদন কমছে

নদী-হাওর-খাল-বিলের এ নদীমাতৃক দেশে মাছের উৎপাদন কমছে। জলাশয়গুলো থেকে বছরে এ উৎপাদন ১০ হাজার টন কমে গেছে। অপরিকল্পিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, শুকনো মৌসুমে উজানের পানি প্রত্যাহার, নির্বিচারে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা নিধনসহ প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানাবিধ কারণে এ উৎপাদনের পতন। কয়েক দশক আগেও দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশ এ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আসত। এখন এ উৎপাদন প্রায় ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে বলে মৎস্য অধিদফতরের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের চাহিদা পূরণ করতে হলে বছরে অতিরিক্ত ৫ লাখ টন মাছ উৎপাদন করতে হবে বলেও একই সূত্রে জানা গেছে।

মৎস্য অধিদফতরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের উন্মুক্ত জলাশয় যেমনÑ নদী, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর, দীঘি ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ মৎস্যসম্পদের অন্যতম উৎস। বিগত কয়েক দশকে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানাবিধ কারণ রয়েছে। এদের মধ্যে, পানি নিষ্কাশন, সেচ প্রকল্পের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, রাজম্ব আদায়ের জন্য জলাশয় ইজারা প্রদানপ্রথা, কীটনাশকসহ বিভিন্ন ধরনের কলকারখানার ক্ষতিকর বর্জ্য জলাভূমিতে নিক্ষেপ, পলি জমা ইত্যাদি কারণে দেশে জলাভূমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাওয়াতে মাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে এসব জলাশয় থেকে প্রত্যাশিত উৎপাদনের তুলনায় প্রতি বছর গড় ১০ হাজার টন মাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। পল্লী এলাকার দরিদ্র মৎস্যজীবী বিশেষত ক্ষুদ্র প্রান্তিক মৎস্যজীবীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিন দিন কমে যাচ্ছে। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর সর্বনি¤œ দৈনিক মাছের চাহিদা ৪৬ গ্রাম। এটা মেটাতে হলে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৫ লাখ টন মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে।

মহাপরিকল্পনার তথ্যানুযায়ী, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য উপ-খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৪.৭৩ শতাংশ মৎস্য উপ-খাতের অবদান। দেশের মোট কৃষিজ আয়ের ২৩ শতাংশ মৎস্য উপ-খাত থেকে আসে। বিগত ২০০৮ সালে মৎস্য উপ-খাতে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.০ শতাংশ। দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ আসে মৎস্য উপ-খাত থেকে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয় মাছ। দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ শতাংশ এ সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০০৯ সালে দেশে মাছের চাহিদা ৩২ লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন ছিল, যা ২০১৩ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৪ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিকটনে। এ হিসাবে বর্ধিত জনসংখ্যার পুষ্টিচাহিদা পূরণ, রফতানি পরিমাণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মাছের ব্যবহার বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০-২১ সালে দেশে মোট মৎস্যচাহিদা ৩৯ লাখ ১০ হাজার টনে উন্নীত হবে। পরিচালিত এ কার্যক্রমে আশাব্যঞ্জক ফলাফল অর্জিত হয়েছে। হেক্টরপ্রতি মাছ উৎপাদিত হয়েছে ২ টন পর্যন্ত। বর্তমানে প্লাবনভূমিতে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন মাত্র ২৭১ কেজি। প্রণীত এ পরিকল্পনার আওতায় হেক্টরপ্রতি মাছের বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১.৫০ টন নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ২০২০-২১ সালের মধ্যে প্লাবনভূমিতে সমাজভিত্তিক মাছচাষকার্যক্রম সম্প্রসারণ করে চাষ এলাকা ১ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরে উন্নীত করতে হবে। এতে করে সার্বিকভাবে দেশের মোট প্লাবনভূমির বর্তমান গড় উৎপাদন হার হেক্টরপ্রতি ২৭১ কেজি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০-২১ সাল নাগাদ ৪৯৫ কেজিতে উন্নীত হবে। পুকুর-দীঘিতে মাছচাষ নিবিড়করণ দেশের পুকুর-দীঘিতে বর্তমানে বার্ষিক গড় উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ২.৬৬ টন।

সরকারি জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগকে পুকুর ও খাল নিয়ে জরিপ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর এলজিইডির পক্ষ থেকে সরেজমিন খাল ও পুকুর যাচাই-বাছাই করে জেলাভিত্তিক তালিকা করা হয়। সারা দেশে মোট ১৪ হাজার ৯১০টি খাস পুকুর, দীঘি, ৩ হাজার ৪৯৩টি প্রাতিষ্ঠানিক এবং ৬ হাজার ৫৩৬টি খাস খাল রয়েছে। এসব পুকুর, খালকে পুনঃখননের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণ করে সেচসুবিধা সম্প্রসারণ করা হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্র বলছে, মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারের নেয়া পুকুর, দীঘি খনন ও সংস্কার এবং জলাশয়গুলোর সংস্কারের প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করা গেলে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর চলমান থাকলে দেশ ও দেশের মানুষ সুফল লাভ করতে পারবে না। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরেই মৎস্য অধিদফতরের ২০টি প্রকল্প রয়েছে মৎস্য উন্নয়নে। এসব বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত প্রকল্প। জলাশয়গুলোর উন্নয়নে চলমান একটি প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ৪০৯ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/510370/