১৮ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৫:৫৯

দি ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন

এশিয়াজুড়ে সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে

করোনাভাইরাস মহামারীকালে এশিয়াজুড়ে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস নিয়ে অপপ্রচার, ফেক নিউজ ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে এমন সব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারীকালে ভয়ের আরও কারণ হল সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকারগুলোর আচরণ আরও বেশি কঠোর হয়ে উঠছে। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সমালোচকরা ঘরে ও বাইরে ভীতি ও হামলার শিকার হচ্ছেন।

সাংবাদিকদের সুরক্ষায় সরকারের ভূমিকা খুবই সামান্য, বিশেষ করে দেশটিতে সক্রিয় ইসলামী উগ্রবাদীদের থেকে তাদের সুরক্ষার প্রশ্নে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পাকিস্তানে ৩৩ জন সাংবাদিক খুন হলেও কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য কারও শাস্তি হয়নি। দেশটির জনপ্রিয় চ্যানেল জিও টিভির সম্প্রচার ২০১৮ সালে বেশ কয়েক মাস বন্ধ থাকে। ক্যাবল অপারেটররা রহস্যজনক কারণে এর সম্প্রচার বন্ধ করে দেন।

এতে আরও বলা হয়, আশঙ্কার বিষয় হল- সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাস থাকা দেশগুলো এখন সাংবাদিকদের অগ্রাহ্য করা শুরু করেছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারতের ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেই চান না। তিনি শুধু দূরেই থাকেন না, তার আচরণগুলোও বিরোধপূর্ণ। ফলে সরকারের সমালোচনার কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকদের মামলা দায়ের অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে পড়েছে।

৮ জুন এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়ার এক বিবৃতিতে দিল্লি পুলিশের এক তদন্তের নিন্দা জানানো হয়। এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মোদির দলের মুখপাত্রের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে ওই তদন্ত শুরু হয়। মোদির ট্রল আর্মি সমালোচক রিপোর্টারদের অনলাইনে আক্রমণ চালিয়ে থাকে।

প্রায়ই এসব সাংবাদিকের ঠিকানা কিংবা অন্য ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে দেয়া হয়। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার ঘটনায় তদন্ত চালানো সাংবাদিক রানা আইয়ুবের মুখমণ্ডল কেটে পর্নো ভিডিওতে জুড়ে দেয়া হয়। আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের হুমকির কথা তো রয়েছেই।

বাণিজ্যিক চাপও আছে। বন্ধু নয়, এমন সংবাদপত্রগুলো সরকারি বিজ্ঞাপন পায় না। আর সে কারণে বেশিরভাগ টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রের মালিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে নিতে চাপ দেয়ার সুযোগ পান। করোনা মহামারী এশিয়ার সরকারগুলোকে সাংবাদিকদের ওপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে। রোগটি নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৫১ জনকে গ্রেফতার করে ইন্দোনেশিয়া।

মালয়েশিয়ায়ও মহামারী নিয়ে ফেক নিউজ ছড়ানোর অভিযোগে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে ২৯ ব্যক্তিকে। রোগ নিয়ন্ত্রণে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ায় জারি করা জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে সরকার সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে। ভারতে এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করোনাবিরোধী লড়াইয়ের সময় সাংবাদিকদের ইতিবাচক খবর প্রচারে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। মুম্বাই পুলিশের ভূমিকা আরও এগিয়ে। তারা করোনা মোকাবেলায় ‘সরকারি ভূমিকায় অবিশ্বাস তৈরি করতে পারে’ এমন কোনো কিছু প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে আদেশ জারি করেছে।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের মতে, ২০১৮ সাল থেকে এশিয়ার ১২টিরও বেশি দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইন। ১৮০টি দেশে সংস্থাটি সাংবাদিকদের স্বাধীনতার যে সূচক প্রকাশ করে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়ক দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশ এশিয়ার। তালিকার তলানিতে রয়েছে উত্তর কোরিয়া, তুর্কমেনিস্তান (১৭৯তম), চীন (১৭৭তম) ও ভিয়েতনাম (১৭৫তম)।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন মিলে বাখেলেট বলেছিলেন, করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি দেশ ‘ভিন্নমত বা অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও বিতর্ক’ স্তব্ধ করছে। অনেক দেশই তার সমালোচনা উড়িয়ে দিয়েছে। ভারত, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামসহ আটটি দেশ পাল্টা জানিয়েছে, ‘মহামারীতে অসাধারণ ও অভূতপূর্ব পদক্ষেপ প্রয়োজন হয়’। সরকারগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মতো সংবাদমাধ্যম না থাকার ফলে মহামারী মোকাবেলা অনেক খারাপ হবে, অন্যথায় দেশগুলো আরও ভালো করতে পারত।

দি ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফিলিপাইনে একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। ৫ মে সন্ধ্যা ৭টা ৫২ মিনিটে দেশটির সবচেয়ে বড় সম্প্রচার মাধ্যম এবিএস-সিবিএনের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।

প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সাময়িকভাবে কোম্পানিটির লাইসেন্সের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিয়েছে প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুয়ার্তের প্রশাসন। আর দুয়ার্তের ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস কোম্পানিটির ২৫ বছর মেয়াদের লাইসেন্স নবায়নে মাসের পর মাস টেনে নিয়েছে। সাংবাদিকদের কাছে পরিষ্কারভাবে এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছে, সরকারের কঠোর সমালোচনার পরিণাম কী হতে পারে।

ফিলিপাইনের এ ঘটনা এশিয়ার সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিস্মিত করবে না। কারণ, পুরো এশিয়াতেই সরকারি বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার, ওয়ারেন্ট ছাড়াই ট্যাক্স তদন্ত, ভুয়া অপরাধের অভিযোগ, ফেক নিউজ প্রচারণা, অনলাইন ট্রলসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের চাপ রয়েছে।

যেসব দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে, সেসব দেশে কখনোই এর খুব বেশি ঐতিহ্য ছিল না। প্রায় ৪০ বছর আগে গণহত্যাকারী খেমার রুজ শাসনের পতনের পর থেকে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হান সেন ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।

দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক তৎপরতা ধারাবাহিকভাবে ঠেকিয়ে গেছেন তিনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ কয়েকটি স্বাধীন রেডিও চ্যানেল এবং সমালোচনামূলক পত্রিকা ‘কম্বোডিয়া ডেইলি’ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী সমালোচকদের বিরুদ্ধে চার বছরে ৫২টি মামলা করেছে। এর অর্ধেকের বেশি করা হয়েছে গত এক বছরে। সেনাবাহিনীর হাতে বেসামরিক নাগরিক হত্যার তথ্য

উন্মোচন করে এক বছরের বেশি কারাদণ্ড ভোগ করেছেন ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দুই সাংবাদিক। অন্যদিকে দায়ী সেনাসদস্যরা তাদের চেয়েও কম সময় কারাগারে কাটিয়েছেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/316957