১৪ জুন ২০২০, রবিবার, ৪:০৬

হাসপাতালে শয্যা সংকট তীব্র

বিনা চিকিৎসায় পথে পথে রোগীর মৃত্যু

সারা দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮৪ হাজারের বেশি। তাদের চিকিৎসার জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসোলেশন, আইসিইউ এবং ডায়ালাইসিস শয্যা আছে ১২ হাজার ৪৭৫টি। এর মধ্যে খোদ ঢাকায় যন্ত্রাংশ ও লোকবলের অভাবে ৭৩টি আইসিইউ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আক্রান্তের সাত ভাগের এক ভাগ শয্যা থাকায় অধিকাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না।

করোনাসহ অন্য রোগে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীরা ভর্তির জন্য হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ফলে তাদের অধিকাংশই বিনা চিকিৎসায় বাড়িতে বা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালের পথেই মারা যাচ্ছেন। এক সপ্তাহে ৫৭ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিন মাসে করোনা উপসর্গ নিয়ে ৮৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। যাদের কেউ হাসপাতালে চিকিৎসা পাননি। বেঁচে থাকাবস্থায় নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারেননি তারা করোনা আক্রান্ত কি না। এরপরও করোন আক্রান্তদের চিকিৎসার বাইরে রয়ে গেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ২৫০ শয্যা, ১৪টি আইসিইউ শয্যা, ডায়ালাইসিস মেশিন দুটি প্রস্তুত থাকার পরও রোগী ভর্তি করছে না কোভিড-১৯ নির্ধারিত একাধিক হাসপাতাল। এ পরিস্থিতিতে সব হাসপাতাল-ক্লিনিকে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারি নির্দেশনার বাস্তবায়ন চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে প্রয়োজনে তাঁবু টানিয়ে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, কোভিড-১৯ রোগটি আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় থাকবে বলে মনে হচ্ছে। তাই আমরা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার পরিকল্পনা গ্রহণ করছি। এক্ষেত্রে হাসপাতাল শয্যা বাড়ানোসহ নানা কার্যক্রম রয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) এবং মন্ত্রণালয়ের করোনা সংক্রান্ত ফোকাল পার্সন হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তাঁবু টানিয়ে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে জানান তিনি। তবে তার আগে বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই সবার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে আইসোলেশন শয্যা রয়েছে ১২ হাজার ৩৪টি। আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৩৩৯টি আর ডায়ালাইসিস শয্যা রয়েছে ১০২টি। যদিও ঢাকার বাইরে কোনো ডায়ালাইসিস শয্যা নেই। ঢাকা সিটিতে আইসোলেশন শয্যা ৫ হাজার ৩০০টি, আইসিইউ শয্যা ১৫৮টি। ঢাকা বিভাগে আইসোলেশন শয্যা ১ হাজার ৩৯৬টি, আইসিইউ শয্যা ৪৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে আইসোলেশন শয্যা ১ হাজার ১৩৮টি, আইসিইউ শয্যা ৩৪টি, ময়মনসিংহে আইসোলেশন শয্যা এক হাজার ৮০টি এবং আইসিইউ শয্যা ৭টি, বরিশালে আইসোলেশন শয্যা ৪১৩টি এবং আইসিইউ শয্যা ১৮টি, সিলেটে আইসোলেশন শয্যা ৩৪৮টি এবং আইসিইউ শয্যা ১৬টি, রাজশাহী আইসোলেশন শয্যা ৯২৪টি এবং আইসিইউ ২৮টি, খুলনায় আইসোলেশন শয্যা ৭১৩টি, আইসিইউ ১৮টি। রংপুরে আইসোলেশন শয্যা ৭২২টি এবং আইসিইউ শয্যা ১৩টি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল হাসান জানান, এ মুহূর্তে রাজাধানীতে সরকারি হাসপাতালে সচল আইসিইউ আছে ১৩৭টি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কোভিড-১৯ নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর লোকবল ও যন্ত্রাংশের অভাবে ৭৩টি আইসিইউ শয্যায় রোগীদের সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

সরকারি হিসাবে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে দেখানো হচ্ছে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ২৬টি। কিন্তু এর সচল আইসিইউ শয্যা মাত্র ১৬টি। আরও ১০টি আইসিই শয্যা লোকবলের অভাবে কাজে আসছে না। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি আইসিইউ শয্যার ১৪টি সচল, বাকি দুটি নষ্ট। তবে এই হাসপাতালে কোনো সাধারণ রোগী এ পর্যন্ত ভর্তি করা হয়নি। রাজধানীর মহানগর হাসপাতালে ৫টি আইসিইউ শয্যা থাকলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য খাতাকলমে আছে ৪৮টি আইসিইউ শয্যা। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর আছে ১৪টি। তবে মুগদার ১০টি আইসিইউ সচল রয়েছে। এখনও প্রস্তুত নয় লালকুটি হাসপাতালের ৫টি আইসিইউ শয্যা। যদিও এগুলো হিসাবের খাতায় রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুর্মিটোলা হাসপাতালের দ্বায়িত্বশীল একজন চিকিৎসক জানান, এই হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যা সচল রয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতরের খাতাকলমে দেখানো হচ্ছে ২৭টি।

প্রস্তুত থেকেও রোগী ভর্তি করছে না একাধিক হাসপাতাল : মহাখালীতে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ২৫০, আইসিইউ শয্যা ১৪, ডায়ালাইসিস মেশিন দুটি। জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে এখনও রোগী ভর্তি শুরু হয়নি। বসুন্ধরা কোভিড হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা দুই হাজার। তবে এই হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা ডায়ালাইসিস সেবার ব্যবস্থা নেই। এখনও সংযুক্ত হয়নি ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশন মার্কেটে নির্মিত ১৪শ’ শয্যার হাসপাতাল। তবে শিগগিরই যুক্ত হতে পারে আরও দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে। এ দুটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিগগিরই চিকিৎসা শুরু হতে পারে।

চিকিৎসার বাইরে বিএসএমএমইউ : সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের মতে, সরকার ঘোষিত যেসব হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৩০ বা এর অধিক, সেসব হাসপাতলে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শয্যা কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে। কিন্তু তা মানছে না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের এক চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জহির আহমেদের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। তারা বলেন, জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিশেষায়িত হাসপাতালটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স নামে পরিচিত হলেও সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। দেশের স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, অন্যান্য জনবলসহ অত্যাধুনিক চিকিৎসা সামগ্রী, অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও কোভিড-১৯ রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা না হওয়া দুখঃজনক। তারা অবিলম্বে হাসপাতালে নির্দিষ্ট সংখ্যক শয্যা ও নিবিড় আইসিইউ শয্যা কোভিড রোগীদের সেবার জন্য উন্মুক্ত করার আহ্বান জানান।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে বিএসএমএমইউতে ৩শ’ শয্যার কোভিড ইউনিট চালু হচ্ছে। হাসপাতালের কেবিন ব্লকে এই কোভিড ইউনিট হবে। পর্যায়ক্রমে বেতার ভবনে আরও একশ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ড করা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের গবেষণা : এতে বলা হয়েছে, ৩১ মে থেকে ৬ জুন পর্যন্ত ৫৭ রোগী হাসপাতাল সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ৩০ জনকে সমাধীস্থ করতে বাধা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটে ৬৩ বছর বয়স্ক একজন ৬টি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান। যিনি শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন। জয়পুরহাটে মিজানুর রহমানকে করোনা সন্দেহে গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া হয়। নওগায় ১৯ বছর বয়সী এক অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যু হলেও করোনা সন্দেহে তাকে কবর দিতে বাধা দেয়া হয়। খুলনা সদরে কোভিড চিকিৎসা দিচ্ছে এমন ৬ চিকিৎসককে হোটেল থেকে বের করে দেয়া হয়। এই সময়ে করোনা উপসর্গ নিয়ে ৮৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ঢাকায় ২২৩ জন, চট্টগ্রামে ২২৯ জন, খুলনায় ৯৭ জন, বরিশালে ৮৮ জন, রংপুরে ৫৩ জন, ময়মনসিংহে ২৭ জন, রাজশাহীতে ৮২ এবং সিলেটে ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

জানা গেছে, সিলেট নগরের একেক করে ছয়টি বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মনোয়ার বেগমের (৬৩) মৃত্যু হয়। সিলেট নগরের কাজীরবাজার মোগলটুলা এলাকার বাসিন্দা ওই নারী তিন দশক ধরে অ্যাজমা রোগে ভুগছেন। ৩১ মে রাত ১২টার দিকে তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে অ্যাম্বুলেন্সে তাকে প্রথমে সোবহানীঘাটস্থ বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আল-হারমাইন হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে চিকিৎসাসেবা না দিয়ে শ্বাসকষ্টের রোগী শুনে অ্যাম্বুলেন্সে রেখেই আইসিইউ নেই বলে অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। অথচ এই হাসপাতালে সবচেয়ে বড় আইসিইউ ইউনিট রয়েছে। এরপর আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে নর্থ ইস্ট মেডিকেলে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। নর্থ ইস্ট হাসপাতাল যাওয়ার পর অক্সিজেন সুবিধা নেই বলে ওখানেও তাকে রাখা হয়নি। রোগীর স্বজনরা তাকে আবারও সোবহানীঘাটস্থ মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে এলে বয়স্ক রোগীদের আইসিইউ ব্যবস্থা নেই বলে চিকিৎসা দেয়া হয়নি। তবে রোগীর স্বজনরা বাকবিতণ্ডা করে সেখান থেকে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করেন। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে নিয়ে আসা হয় সিলেট নগরের তেলিহাওর এলাকায় পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা রোগীকে রাগীব-রাবেয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী রাগীব-রাবেয়া হাসপাতালে নিয়ে আসার পর রোগীকে এক্সরে ও অন্য পর্যবেক্ষণের পর এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। তখন রোগী প্রচণ্ড বুকের ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট থেকে বাঁচাতে আকুতিমিনতি করছিলেন। রাত আড়াইটার দিকে ওসমানী হাসপাতালের গেটে পৌঁছামাত্র ওই নারী মারা যান। পরে ওসমানী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ওই নারী রোগীকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতিদিন দেশের অনেক শহরেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/315596/