১০ জুন ২০২০, বুধবার, ১০:২০

বাড়তি প্রণোদনা আদায়ে তৎপর গার্মেন্ট মালিকরা

করোনাকালীন বাজেট শিল্প ও বাণিজ্যবান্ধব হওয়ার প্রত্যাশা

আসন্ন বাজেটে বাড়তি প্রণোদনা আদায়ে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা। বিশ^ব্যাপী করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের তিনটি প্রধান সংগঠনের নেতারা এ জন্য রাতদিন পরিশ্রম করে চলেছেন। সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে তাদের কাছে ঘন ঘন ধরনা দিচ্ছেন। ব্যবহার করছেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা পোশাক শিল্পোদ্যোক্তাদের। পাশাপাশি সম্ভাব্য বিপর্যয় বিষয়ে দেশবাসীর অনুকম্পা আদায়ে তুলে ধরছেন করোনার ধ্বংসচিত্র। বিশেষ করে করোনাকালীন অর্ডার বাতিলের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসে শ্রমিকদের কর্মহীন হয়ে পড়ার চিত্রটি তারা বারবার সামনে নিয়ে আসছেন । তারা আশা করছেন, করোনাকালীন আসন্ন বাজেট হবে শিল্প ও বাণিজ্যবান্ধব।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৩১৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে আসন্ন বাজেটে তারা সরকারের কাছ থেকে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারে উৎপাদিত পণ্য রফতানিতে ১০ শতাংশ এবং আমদানি কাঁচামাল ব্যবহারে উৎপাদিত পণ্য রফতানিতে ৪ শতাংশ হারে নগদসহায়তা প্রত্যাশা করছেন। চলতি অর্থবছরে এ দুই ধরনের পণ্য রফতানিতে নগদসহায়তার বিধান রয়েছে যথাক্রমে ৪ ও ১ শতাংশ। তারা চান স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত সব পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট মওকুফ, রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি, ক্রেতাদের বাতিল করা রফতানি আদেশ তথা স্টকলট হওয়া পণ্য বিক্রি করতে ভার্চুয়াল মার্কেট প্লেসের অনুমতি। অ্যামাজন-আলিবাবার মতো একটি বিশেষ সার্টিফায়েড সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে কাজ করার অনুমতি চায় বিজিএমইএ।

বাজেটে সংযুক্ত করার জন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমএ যেসব প্রস্তাব নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে তাতে রয়েছেÑ ডলারপ্রতি অতিরিক্ত পাঁচ টাকা বিনিময় হার দেয়া, বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নেয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা, পরিষেবা বিলের ভর্তুকিমূল্য নির্ধারণ করা, রাজধানী থেকে কারখানাগুলোকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) স্থানান্তরিত করলে বিশেষ কর অবকাশ সুবিধা দেয়া এবং উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করা বাজারগুলোতে (যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল) রফতানির ওপর বিশেষ প্রণোদনা দেয়া। তাদের মতে, মৌলিক পণ্যের বাইরে নতুন ক্যাটাগরিতে পোশাক উৎপাদন এবং কারিগরি উৎকর্ষতা উৎসাহিত করার জন্য পাঁচ শতাংশ নগদসহায়তা প্রদান করা দরকার। এ ক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্যে যৌথ বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি কর অবকাশ প্রদান করা এবং নিজস্ব ডিজাইন ও ব্র্যান্ডের পণ্য রফতানি করার জন্য ১০ শতাংশ নগদসহায়তা চায় সংগঠনগুলো। এ ছাড়াও সরকারের সোশ্যাল সেফটি নেট প্রকল্পের আওতায় পোশাকশ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের পুষ্টি, বাসস্থান, যাতায়াত ও শিক্ষা খাতের জন্য ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ চান তারা।

বাজেটে নীতিগত সহায়তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, বিজিএমইএর নিবন্ধিত কারখানা ছিল দুই হাজার ২৭৪টি, তার মধ্যে এখন এক হাজার ৯২৬টি চলছে। অর্থাৎ বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। করোনায় বিশ্বে ভোক্তার চাহিদা কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা বলছে, আগামীতে ৬৫ শতাংশ ভোগচাহিদা কমে যাবে। তাই পোশাকের চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনা কম। তিনি বলেন, দেশের পোশাক কারখানায়ও ৫৫ শতাংশ (চাহিদা) কমে যাবে। ৪২ হাজার কোটি টাকা মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ক্ষতি হবে। করোনায় দেশের ৯৯ শতাংশ পোশাক কারখানা ৫৫ শতাংশ ক্যাপাসিটি দিয়ে চালাতে হবে। জুনে কারখানাগুলোতে ৩০ শতাংশ কাজ হবে। জুলাইয়ে কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। আমাদের বড় ধাক্কা খেতে হবে। এটি অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ সহায়তা ছাড়া এ খাতকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

সরকারি সুবিধা আদায়ে বরাবরের মতো এবারো শ্রমিকদের ইস্যুটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন উদ্যোক্তারা। তাদের দাবি, করোনার কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে কাজ হারাচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে আইনি সহায়তার পাশাপাশি কারখানা বন্ধ করে সহজে বাড়ি যাওয়ার পথও চাচ্ছেন তারা সরকারের কাছে। গার্মেন্ট মালিকদের বাজেটীয় দাবির মধ্যেই যুক্ত হয়েছে, রুগ্ন ও দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কারখানাসহ যেকোনো সময় উদ্যোক্তারা ব্যবসা থেকে বের হয়ে যেতে চাইলে তাদের জন্য এক্সিট পলিসি তৈরি করার বিষয়টি। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনেরও দাবি করেছেন তারা। দাবির মধ্যে রয়েছে শিল্প খাত বহুমুখীকরণে কারিগরি ও অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তাদের বিশেষ সহায়তা দেয়া। এ জন্য বিশেষ উৎসাহ এবং ১০ শতাংশ নগদসহায়তা ১০ বছরের জন্য প্রদান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থানান্তর এবং নতুন ভবন নির্মাণ বাবদ বিশেষ ঋণসুবিধা প্রদান, ১৫ বছর মেয়াদি এবং বাণিজ্যিক সুদহারের অর্ধেকে প্রদান করার বিষয়টিও।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তৈরী পোশাক শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকেই বর্তমানে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, বস্ত্রমন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীরসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পোশাক শিল্পোদ্যোক্তাদের নেতা ছিলেন। বর্তমান সংসদ সদস্যদের এক- তৃতীয়াংশ পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তা। এ ছাড়া রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশ অর্জনকারী এ শিল্প খাতের সাথে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো অগ্র ও পশ্চাৎশিল্প। তৈরী পোশাক শিল্পের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে লাখ লাখ শ্রমিকের রুটি-রুজি। এসব বিবেচনায় আসন্ন বাজেটে এ শিল্পের জন্য ভালো কিছু আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/507253