৬ জুন ২০২০, শনিবার, ১২:৫৩

জীবনের সঙ্গে আঘাত জীবিকায়ও

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। বড় আঘাত এসেছে মানুষের জীবন-জীবিকায়। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বা সরকারি চাকরিজীবীরা নিরাপদ অবস্থানে থাকলেও বিপর্যয় নেমে এসেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এ কারণে কর্মসংস্থানের ওপর এসেছে বড় ধাক্কা। নতুন করে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ব্যাপক হারে কমেছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রক্রিয়া থেমে গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়ে বেকার হওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। পোশাকশিল্প খাতসহ বেসরকারি বিভিন্ন খাতে কমবেশি ছাঁটাই চলছে।

এ অবস্থায় দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের তালিকা লম্বা হচ্ছে। আয় কমছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও। সুরক্ষা সহায়তা দিয়ে ধাক্কা সামলে উঠার চেষ্টা করছে সরকার।

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা অনলাইন মাধ্যমের তথ্য তুলে ধরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত কভিড-১৯ রোগের কারণে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমেছে। চাকরির বাজার সংকুচিত হয়েছে।

গত ২৯ মে প্রকাশিত এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়, কভিড-১৯-এর প্রভাবে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের অনলাইন মাধ্যম বিডিজবসে এপ্রিল মাসে বিজ্ঞপ্তি কমেছে ৮৭ শতাংশ। চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে শীর্ষে থাকা এই প্রতিষ্ঠানে ওই মাসে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় মাত্র ১৩ শতাংশ। দেশের সব খাতে চাকরির নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ কমেছে। তবে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে কমার হার বেশি।

গত ১২ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি ঘোষণা করে। ওই সময় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এক প্রতিবেদনে ১৬০ কোটি মানুষের চাকরি হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে হুঁশিয়ারও করেছিল সংস্থাটি।

বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম মাসরুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার প্রভাবে চাকরির নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ব্যাপক হারে কমেছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গত এপ্রিল মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ৮০ শতাংশের বেশি কমেছে। আর মে মাসে কমেছে ৭৫ শতাংশ।’

গত জুলাই মাসে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকার ২৩ লাখ ৭৭ হাজার। এর মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত, যাঁরা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। উচ্চশিক্ষা পর্বের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করা বেকারের সংখ্যা চার লাখ পাঁচ হাজার। অশিক্ষিত বেকার তিন লাখ।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৪টি অধিভুক্ত/অঙ্গীভূত কলেজের শিক্ষার্থী ব্যতীত) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়সহ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যা সাত লাখ ১৪৮।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাকরিপ্রত্যাশীদের একটি অংশ টারশিয়ারি বা উচ্চশিক্ষা স্তর শেষে চাকরিতে নিয়োগ পেতে প্রস্তুতি নেয়। স্নাতকোত্তর শেষে একটি অংশ পিএইচডি বা এমফিল কোর্সে পড়ে। তারা শিক্ষা সম্বন্ধীয় কাজে সংযুক্ত থাকলেও বড় অংশ সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেয়। এই হিসাবে প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা শেষ করে প্রায় সাত লাখ তরুণ চাকরি করার উপযোগী হন। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তথ্য অনুযায়ী, ৪১তম বিসিএসে আবেদনকারী প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ। সেই হিসাবে বলা যায়, উচ্চশিক্ষিত বেকার পাঁচ লাখের বেশি।

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ। প্রথম মৃত্যুর ঘটনা জানা যায় ১৮ মার্চ। করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। জরুরি সেবা, ওষুধ, কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান ছাড়া সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৬৬ দিন পর গত ৩১ মে সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার করা হয়, যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো খোলেনি।

সাধারণ ছুটির সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে। সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের পর গত কয়েক দিনে দু-একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনোটিতে আবেদনের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। মার্চ মাস থেকে অন্তত ৫০টির বেশি নিয়োগপ্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। নতুন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও তো নেই-ই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। কোনো নিয়োগ পরীক্ষার নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও মৌখিক পরীক্ষা হয়নি। আবার কোনোটিতে মৌখিক পরীক্ষা শেষ হলেও চূড়ান্ত ফল হয়নি। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের নির্ধারিত বয়সসীমা ৩০ বছর অনেকের শেষ হতে চলেছে; কিন্তু চাকরিপ্রত্যাশীদের নিয়ে সরকারের কোনো নির্দেশনা নেই।

সরকারের জনপ্রশাসন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগের দায়িত্ব পালন করে পিএসসি। ২০১৭ সালের ২০ জুন দুই হাজার ২৪ পদে নিয়োগ দিতে ৩৮তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। এরপর নৈর্ব্যক্তিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়নি। প্রায় তিন বছর হতে চলেছে, অন্তত ১০ হাজার চাকরিপ্রত্যাশী চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষায় রয়েছেন।

এ ছাড়া ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আর ৪১তম বিসিএসের আবেদনপত্র গ্রহণ সম্পন্ন হলেও বাছাই পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মাঝখানে ৩৯তম বিসিএসের (বিশেষ) মাধ্যমে চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে।

উচ্চশিক্ষার পাট চুকিয়ে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন তরুণরা। তাঁদের কেউ কেউ একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন। কিন্তু সংকটময় পরিস্থিতিতে নিয়োগ কার্যক্রম স্থবির থাকায় চাকরি পাচ্ছেন না।

কবি নজরুল সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা এক তরুণী নাম প্রকাশ না করে কালের কণ্ঠকে বলেন, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করতে তাঁদের লেগেছে সাত বছর। ছয় বছর হাতে থাকতে চাকরির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তিনি। এখন হাতে আছে প্রায় এক বছর। বিগত চার বছরে অনেক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন; কিন্তু চাকরি হয়নি। তিনি বলছিলেন, তাঁর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শেষ হতে চলেছে। ৪১তম বিসিএসে আবেদন করেছেন। আর এটির পর হয়তো আর কোনো বিসিএসে আবেদন করতে পারবেন না। এক বিসিএসে মৌখিক এবং আরেকটিতে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। এর কোনোটিতে উত্তীর্ণ হতে না পারলে সরকারি চাকরির আর সুযোগ থাকবে না।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাকরিপ্রত্যাশীদের সংকট ও নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত না হওয়ার বিষয়টি আমাদের নলেজে আছে, যদিও অক্টোবর ও নভেম্বরের দিকে সরকারি বিজ্ঞপ্তিগুলো প্রকাশিত হয়। এই পরিস্থিতিতে তাদের জন্য কী করা যায়, সেটি দেখব। এগুলো নীতিনির্ধারণী বিষয়। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

করোনাভাইরাসের কারণে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত না হওয়ায় অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেছে, তাঁদের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে কি না, এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আলোচনা করব, কিছু করা যায় কি না, সেটি দেখব। যেসব পরীক্ষা আংশিক হয়েছে, সে ক্ষেত্রে তাদের কোনো সমস্যা হবে না।’

এদিকে সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জনবল নিয়োগ দিতে সুপারিশ করে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি সচিবালয় (বিএসসিএস)। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই সচিবালয় চাহিদা পাওয়ার পর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আর বাছাইয়ের পর তিন ধাপ সম্পন্ন করে চূড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ করে।

ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যসচিব আরিফ হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কয়েকটি সমন্বিত পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে, আবেদন নেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে কমসংখ্যক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’

বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র কল্যাণ পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক মোজাম্মেল মিয়াজী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম পিছিয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/06/06/919692