২১ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৪:২১

পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশনা মানা হয়নি

এডিপিতে অনুমোদনহীন নতুন প্রকল্পের ছড়াছড়ি

যাচাই-বাছাই না করেই প্রস্তাব করেছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো * জুলাইয়ের শেষে অগ্রাধিকার তালিকা করা হবে -পরিকল্পনা সচিব * উন্নয়নে বিশৃঙ্খলা ও অপচয়ের শঙ্কা আছে -ড. জাহিদ হোসেন

পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশনা না মেনে এবং যাচাই-বাছাই না করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যাপক নতুন প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ রকম এক হাজার ৩৪৭টি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্পগুলো ‘বরাদ্দহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প’ শীর্ষক তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। এ তালিকা চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি এবং সংশোধিত এডিপির তুলনায় দীর্ঘ। করোনাভাইরাসের কারণে রাজস্ব আয় কম হওয়ায় এডিপি নতুন প্রকল্পের চাপে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে উন্নয়ন কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং অর্থের অপচয় হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা সচিব মো. নূরুল আমিন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, এসব প্রকল্প যাচাই-বাছাই করে প্রস্তাব করা হয়নি। করোনার কারণে সেটি হয়তো সম্ভবও হয়নি। বলা চলে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পগুলো আমরা অন্তর্ভুক্ত করেছি। আগামী জুলাইয়ের শেষদিকে এ তালিকা থেকে একটি অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা হবে। যেখানে তিন ধরনের অগ্রাধিকার প্রকল্প থাকবে। উচ্চ, মধ্যম এবং নিু অগ্রাধিকার। এরপর সেই তালিকা ধরেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণায়লগুলো প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াকরণের জন্য পাঠাবে। এরপরই আগামী অর্থবছরে অনুমোদনের জন্য প্রকল্প যাবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপি তৈরির নির্দেশিকায় পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছিল- নতুন প্রকল্প গ্রহণের চেয়ে চলমান প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বিবেচনায় নিতে হবে। একই সঙ্গে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো (এমটিবিএফ) এবং আগামী অর্থবছরের প্রক্ষেপণ বিবেচনায় নিয়ে নতুন প্রকল্প প্রস্তাব করতে হবে।

সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের জন্য তালিকায় যুক্ত হতে যাওয়া নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬২টি প্রকল্প হল ভৌত-পরিকল্পনা-পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাতের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কৃষি খাতের ২০৫টি। তৃতীয় সর্বোচ্চ ২০১টি প্রকল্পে রয়েছে পরিবহন খাতের। এছাড়া পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতের ৬৮টি, পানিসম্পদ খাতে ১২৭টি, শিল্প খাতে ৬২টি, বিদ্যুৎ খাতে ১১টি, তেল-গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে ১০টি এবং যোগাযোগ খাতে ১২টি প্রকল্প রয়েছে। এছাড়া শিক্ষা ও ধর্ম খাতে ১০৯টি, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাতে ৪৬টি, স্বাস্থ্য-পুষ্টি-জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৬০টি, গণসংযোগে ২১টি, সমাজকল্যাণ-মহিলাবিষয়ক ও যুব উন্নয়ন খাতে ৬৮টি, জনপ্রশাসনে ৪১টি, বিজ্ঞান-তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ৩০টি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান খাতে ১৪টি প্রকল্প রয়েছে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রাজস্ব ঘাটতি ও ব্যয়ের ওপর চাপ রয়েছে। এর ওপর এ রকম বেশি পরিমাণে নতুন প্রকল্প ব্যয়ের চাপটাকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করবে। সবাই চাইবে তার প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করুক। এভাবে শেষ পর্যন্ত অনুমোদন দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরাদ্দ দেয়া হতে পারে। ফলে যে টাকাটা বরাদ্দ থাকবে সেটি গাড়ি ক্রয়, গাড়ির তেল, সংশ্লিষ্টদের বেতন-ভাতা দিতেই ফুরিয়ে যাবে। আসল কাজ কিছুই হবে না। সেখানে অর্থের অপচয় ঘটতে পারে। সার্বিকভাবে এটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিশৃঙ্খলা ঘটাতে পারে।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে বরাদ্দহীনভাবে অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় ১ হাজার ৪৫টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে অর্থবছরের নয় মাসের মাথায় মার্চে সংশোধিত এডিপিতে ২৭৪টি কমিয়ে প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৭১টি। কিন্তু ১৯ মার্চ সংশোধিত এডিপি এনইসিতে অনুমোদন লাভের পর লকডাউনের কারণে একটিও একনেক বৈঠক হয়নি। ফলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য খাতের দুটি এবং মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা সংক্রান্ত একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এ তালিকাভুক্ত কোনো প্রকল্পই অনুমোদন লাভ করেনি। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে সংশোধিত এডিপির তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে ৫৭৬টি নতুন প্রকল্প। আর মূল এডিপির তুলনায় বাড়ছে ৩০২টি নতুন প্রকল্প। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় উপস্থাপন করা প্রস্তাবনায় বলা হয়- অননুমোদিত প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই না করেই বরাদ্দহীনভাবে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই আগামী অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পরিকল্পনা কমিশনের উদ্যোগে প্রকল্পের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হবে। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) সিলিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশ দেয়া যেতে পারে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/309070/