২১ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৪:১৯

বিশ্লেষক ও শ্রমিক নেতাদের প্রশ্ন

বেতনের দাবিতে গার্মেন্ট শ্রমিকরা এখনও রাস্তায় কেন

২ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী ঋণ প্রণোদনা প্যাকেজ দিলেও ঈদের আগে বেতন-বোনাস পাননি অনেকে * দায় নিতে চান না কেউ, একে অপরকে দোষারোপ, নির্বিকার কলকারখানা অধিদফতর * শিল্প পুলিশের তালিকা ত্রুটিপূর্ণ -বিজিএমইএ

ঈদের মাত্র ২ দিন বাকি। কিন্তু বেতন-বোনাসের দাবিতে বুধবারও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ করেছেন। কবে বেতন পাবেন, সে নিশ্চয়তাও নেই। অথচ প্রধানমন্ত্রী পোশাক খাতের এ সংকট অনুধাবন করতে পেরে ২ মাস আগেই ৫ হাজার কোটি টাকার প্রথম প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। কিন্তু এখনও ৩ হাজারের বেশি কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী বেতন পাননি। এক্ষেত্রে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের (ডিআইএফই) মুখ্য ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও সংস্থাটি একেবারে নির্বিকার। আইন অনুযায়ী যা করার ছিল তার কিছুই করেনি সরকারি এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অপরদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় এড়াতে গার্মেন্ট মালিক ও ব্যাংক একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। এছাড়া গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন বকেয়াসংক্রান্ত শিল্প পুলিশের তথ্যও মানতে নারাজ বিজিএমইএ। পোশাক রফতানিকারকদের এ সংগঠনটির নেতারা বলছেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া গার্মেন্টও পুলিশের তালিকায় রয়েছে।

শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, সারা দেশে ৭ হাজার ৬০২টি গার্মেন্ট কারখানার মধ্যে এপ্রিলের বেতন দেয়নি ৩ হাজার ২৫৮টি কারখানা। বোনাসের অবস্থা আরও ভয়াবহ। মাত্র ৮২৮টি কারখানা ঈদ বোনাস দিয়েছে। অর্থাৎ ৬ হাজার ৭৭৪টি কারখানা বোনাস দেয়নি। বেতন পরিশোধে সবচেয়ে এগিয়ে আগে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (বেপজা) অবস্থিত কারখানাগুলো। আর বিজিএমইএর ১ হাজার ৮৮২টি কারখানার মধ্যে বেতন বাকি আছে এখনও ৪৮৯টি কারখানার, বিকেএমইএ ১ হাজার ১০১টি কারখানার মধ্যে বাকি আছে ৬৩৫টির এবং বিটিএমএর ৩৮৯টির মধ্যে বাকি আছে ১৬৮টির।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গার্মেন্টকর্মীরা সামান্য বেতন পান। এখন এ সামান্য বেতনও যদি তারা না পান তাহলে যাবেন কোথায়। তারা মনে করেন, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়িত্বে অবহেলার কারণে বেতন না পেয়ে শ্রমিকরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী ২৫ মার্চ শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিশ্চিত করতে প্রণোদনা তহবিলের ঘোষণা করেন। অথচ ঈদের ২ দিন বাকি থাকলেও বোনাস তো দূরের কথা, শ্রমিকদের অনেকে বেতনও পাননি। এখন শেষ সময়ে এসে একপক্ষ অন্য পক্ষকে দোষারোপ করছে। এ দোষ চাপাচাপিতে প্রকারান্তরে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কলকারখানা অধিদফতরের ভূমিকাও অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা রাস্তায় নামলেও এখন পর্যন্ত কোনো কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সংস্থাটিকে।

তারা আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের সময় বিজিএমইএ-বিকেএমইএ বলে দেশে গার্মেন্টকর্মীর সংখ্যা ৪১ লাখের বেশি। কিন্তু এখন বিজিএমইএ বলছে, তাদের শ্রমিক সংখ্যা ২২ লাখের কিছু বেশি। অন্য শ্রমিকদের দায় বিজিএমইএ নেবে না। অন্যদিকে প্যাকেজ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের গাফিলতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ অসন্তোষের দায় ব্যাংক, গার্মেন্ট মালিক ও প্যাকেজ বাস্তবায়নে জড়িত সরকারি আমলারাও এড়াতে পারেন না। এছাড়া গার্মেন্টের কাজ সাব-কন্ট্রাক্টে করানোর কোনো সুযোগ নেই। অথচ পুলিশের পক্ষ থেকে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে দেখা গেছে, বিপুলসংখ্যক গার্মেন্ট কারখানা চালানো হচ্ছে সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়ে। যাদের বেতন ও বোনাস নিয়ে বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া সাব-কন্ট্রাক্ট দিলে কমপ্লায়েন্স গার্মেন্ট হতে পারবে না। তাই বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে।

এ বিষয়ে বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক বুধবার যুগান্তরকে বলেন, শিল্প পুলিশের তথ্য সঠিক নয়। মেট্রোপলিটন এলাকার গার্মেন্ট তাদের তালিকায় রাখা হয়নি। অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাও তালিকায় রাখা হয়েছে। ফলে তাদের তালিকাটি ত্রুটিপূর্ণ।

সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ফয়সাল সামাদ বলেন, বিজিএমইএভুক্ত ৯০ শতাংশের বেশি কারখানায় বেতন দেয়া হয়ে গেছে। বাকি কারখানাগুলোতে শনিবারের মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হবে। এখন কিছু জায়গায় শতভাগ বোনাসের দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন, যা যৌক্তিক নয়। কারণ ত্রিপক্ষীয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, এবার ঈদে ৫০ ভাগ বোনাস দেয়া হবে। বাকিটা ঈদের পরে বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।

বিকেএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, প্রধানমন্ত্রী মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ২ মাস আগে প্রণোদনা তহবিল গঠন করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এর সুফল পায়নি শ্রমিকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের বেতনের সব কাগজপত্র ব্যাংকে জমা দিয়েছে। এখন মালিকদের করার কিছুই নেই। অনেক গার্মেন্ট শ্রমিক বেতন পেলেও কিছু কারখানার কাগজপত্র ব্যাংক প্রসেসিং করেনি। সেসব কারখানায় বেতন-ভাতা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক টাকা ছাড় করলেও বিকাশ-রকেট শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে দেরি করছে। বুধবার এ নিয়ে কয়েকজন কারখানা মালিক অভিযোগও করেছেন। এছাড়া শিল্প পুলিশের তথ্য সঠিক নয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বিকেএমইএ’র রফতানিমুখী চালু ৭৬৭টি কারখানার মধ্যে ৫৯৫টি এপ্রিলের বেতন পরিশোধ করেছে। বাকি ১৭২টিও শনিবারের মধ্যে বেতন পরিশোধ করবে।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী প্যাকেজ ঘোষণা করলেও গার্মেন্ট মালিক ও ব্যাংক বেতন দেয়ার কাগজপত্র কমপ্লিট করতে পারেনি, এটা মানা যায় না। গার্মেন্ট মালিকদের গাফিলতির কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া একটা কারখানা চালু করতে সব মিলিয়ে ১৮টি সংস্থার অনুমোদন লাগে। এ পরিস্থিতিতে ওই সংস্থাগুলো কী করছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ডিআইএফই সরাসরি মালিকদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। অভিযোগ দিলে তারা মালিকদের পক্ষ হয়ে কথা বলেন। এখন পেটের দায়ে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে। কোনো শ্রমিকই করোনায় আক্রান্ত হতে চায় না। তারপরও এ পরিস্থিতিতে যদি কেউ করোনায় আক্রান্ত হয় তবে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আর ঈদের আগে সব শ্রমিক বেতন না পেলে ঈদের পর কী হবে তা কেউ বলতে পারবে না।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, এখন দোষ চাপাচাপি চলছে। মালিকরা বলছে ব্যাংক টাকা দিচ্ছে না। কিন্তু শ্রমিকদের তো সেটা বুঝে লাভ নেই। প্রধানমন্ত্রী ২ মাস আগে প্যাকেজ দিয়েছেন। আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে এ সমস্যা হতো না।

কলকারখানা অধিদফতরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, ডিআইএফএ সব সময় গার্মেন্ট কারখানার কর্মকাণ্ড মনিটরিং করছে। বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা রাস্তায় নামলেও আজ পর্যন্ত কোনো শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে অভিযোগ জানানো হয়নি। বরং যেসব জায়গায় অসন্তোষ হচ্ছে, সেসব জায়গায় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তাদের কর্মকর্তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে বৈঠক করে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। তিনি আরও বলেন, ২ মে থেকে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে মনিটরিং করছে অধিদফতর। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক কারখানা পরিদর্শন করা হচ্ছে। যেসব কারখানায় ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো সংশোধনের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।

এদিকে এপ্রিল মাসের বেতন ও শতভাগ বোনাসের দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বুধবার বিক্ষোভ করেছে শ্রমিকরা। কমলাপুরে বিন্নি নামের একটি গার্মেন্টের শ্রমিকরা সকালে রাস্তা অবরোধ করে। পরে পুলিশের আশ্বাসে শ্রমিকরা অবরোধ তুলে নেন। শ্রমিকরা জানান, বিকাশে বেতন-ভাতা দেয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি পাননি। এছাড়া শতভাগ বোনাসের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন তারা। এসব শ্রমিকের কারও দুই মাস, কারও এক মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে। এর আগে গত ১৬ এপ্রিল একই দাবিতে বিন্নি গার্মেন্ট কর্মীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিল।

সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সুমিলপাড়া এলাকার ওয়েস্ট নিটওয়্যার লি. কারখানার শ্রমিকরা চলতি মাসের বেতন ও শতভাগ বোনাসের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। বুধবার বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ-আদমজী-ডেমরা সড়ক অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ করে। এতে ঐ সড়কে চার ঘণ্টা যানচলাচল বন্ধ থাকে। খবর পেয়ে র‌্যাব ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়ার পর যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুর রহমান জানান, সুমিলপাড়ার নিটওয়্যার লি. কারখানায় ৭শ’ শ্রমিক কাজ করছে। শ্রমিকরা শতভাগ (পূর্ণ) বোনাসের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ।

গাজীপুর : মহানগরীর টঙ্গী গাজীপুরা এলাকার ক্লাসিক ফ্যাশন কনসেপ্ট লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা সকাল ৮টায় কারখানার সামনে এসে বিক্ষোভ করে। পরে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। টঙ্গীর সাতাইশ লস্করপাড়া এলাকায় আবিদ অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে কারখানা বন্ধ করে চলে যাওয়ায় সেখানেও শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। আটারকল এলাকায় প্রিমিয়ার ওয়াশিং লিমিটেড শ্রমিকরা বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে বিক্ষোভ করে। নগরীর বড়বাড়ি এলাকায় ‘ইন্টার ফ্যাব ম্যানুফেকচারিং লিমিটেড’ কারখানার শ্রমিকরা বেতন ও বোনাসের দাবিতে বিক্ষোভ এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। এতে সড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/309065/