১৮ মে ২০২০, সোমবার, ৩:০৪

স্থানীয় সরকারে বাড়তি বরাদ্দের সুফল পাচ্ছে না জনগণ

১০ বছরে বরাদ্দ বেড়েছে ৩ হাজার ৭৩৭ শতাংশ; গত ৫ বছরে বরাদ্দ বেড়েছে ৫৭ শতাংশের বেশি

উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ প্রতি বছরই বাড়ছে। কিন্তু গত এক দশকে স্থানীয় সরকার বিভাগে বরাদ্দ বেড়েছে ৩ হাজার ৭৩৭ শতাংশ বা ৩০ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। প্রতি বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ বিভাগ থোকসহ বরাদ্দের তালিকায় শীর্ষ তিনটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই অবস্থান করে। তাদের ব্যয় হারও শতভাগের কাছাকাছি দেখা যায়। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপিতে এ খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ৩১ হাজার ১৩১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। কিন্তু এ অর্থ ব্যয়ে সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় সুফল পৌঁছে কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্লেষকগণ বলছেন, মূলত সরকারগুলো রাজনৈতিক কারণেই এ খাতে বরাদ্দ বেশি দিয়ে থাকে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতি ও দুর্র্র্বৃত্তায়নের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আমাদের দেখতে হবে বরাদ্দ কী খাতে হচ্ছে। তার গুণগত মানই বা কী? কিন্তু এসব প্রকল্প শুধু সংশ্লিষ্টদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই নেয়া হয়। রাজনৈতিকভাবে বরাদ্দ ব্যবহার তো হচ্ছেই। বিশ্বব্যাংকের সাথে যেসব প্রকল্প স্থানীয় সরকারের রয়েছে তাতে প্রত্যেকটাতেই বিলম্ব আছে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অভিজ্ঞতা যা, স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে খুব একটা ভিন্নতা আছে বলে মনে হয় না। যে পরিমাণ অর্থ যায় সে পরিমাণ সুফল তো মানুষ পায় না।

পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি থেকে প্রাপ্ত গত একদশকের তথ্যানুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার বিভাগের ১৯টি প্রকল্পের বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ ছিল ৮১১ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। চার বছরের মাথায় এসে এ বরাদ্দ ১৬ হাজার ৭৫৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রকল্প সংখ্যা ছিল ২২৩টি। পরের অর্থবছর প্রকল্প সংখ্যা হলো ২৩২টি। আর এর বিপরীতে এডিপিতে অর্থ বরাদ্দ হয় স্থানীয় সরকার বিভাগে ১৯ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। সেই বছর বাস্তবায়ন হার দেখানো হয় ৯৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে প্রতি বছরে বরাদ্দ বাড়ছে গড়ে তিন হাজার কোটি টাকা করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২২ হাজার ৭৮৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বরাদ্দ পায় বিভাগটি। তাদের মোট প্রকল্প ছিল ২৫২টি। আর সেই বছর বাস্তবায়ন হার প্রকাশ করা হয় ৯৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসে বরাদ্দ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। বরাদ্দ উন্নীত হয় ২৬ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় এবং প্রকল্প সংখ্যা ২৮০টিতে। আর চলতি অর্থবছর এ বিভাগের বরাদ্দ ২৯ হাজার ৭৭৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। যেখানে প্রকল্প ২২৪টি। তবে গত পাঁচ অর্থবছরে এ বিভাগের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে গড়ে ৫৭ শতাংশের বেশি।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের এডিপিতে ইউনিয়ন পরিষদের জন্য উন্নয়ন সহায়তা রাখা হচ্ছে ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া উপজেলা উন্নয়ন সহায়তার জন্য ৬৫০ কোটি টাকা। জেলা পরিষদ উন্নয়ন সহায়তায় ৫ শ’ কোটি টাকা। পৌরসভা উন্নয়ন সহায়তায় সাড়ে ৪ শ’ কোটি টাকা এবং সিটি করপোরেশন উন্নয়ন সহায়তা চার শ’ কোটি টাকা। এ পাঁচটি খাতে মোট বরাদ্দ প্রস্তাব করা হচ্ছে ২ হাজার ২০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে রয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র বলছে, তাদের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষণা, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নয়ন সহায়তা প্রদান, ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স নির্মাণ, উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স নির্মাণ, গ্রামীণ সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়ন, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম সড়ক নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, গ্রামীণ হাট-বাজার ও গ্রোথ সেন্টার নির্মাণ, মহিলাদের জন্য বাজার সেকশন নির্মাণ, ঘূর্ণিঝড়/বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সুবিধা প্রদান। এ ছাড়া শহরের দরিদ্র মা ও শিশুদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও মাতৃসদন নির্মাণ, শহরের দরিদ্র মা ও শিশুদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ইত্যাদি।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুজন সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ খাতে বরাদ্দের অর্থ ব্যয় হচ্ছে মূলত বেতনভাতা ও কিছু কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে। আমাদের দেখতে হবে বরাদ্দ কী খাতে হচ্ছে। তার গুণগত মানই বা কী? আর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর খাতে যেসব থোক বরাদ্দ যাচ্ছে তা খুবই সামান্য ও অত্যন্ত নগণ্য। এ বরাদ্দে কোনো কাজ করারই সুযোগ থাকে না। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাসহ জনগণের অনেকগুলো কল্যাণকর কাজ করা যায়। কিন্তু এ জন্য বরাদ্দ খুবই সীমিত। স্থানীয় সরকারকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব। স্থানীয় সরকারকে পাশ কাটিয়ে সচিব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিয়েই কাজ করানো হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের প্রতি সরকারের অনীহা ও অনাগ্রহ। কারণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন ও নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে এসব প্রতিনিধির জনগণের প্রতি দায়বদ্দতা নেই বললেই চলে। আর পাঁচ বছর পর নির্বাচনে ভোটারদের মুখোমুখি হতে হয় না। দলীয় মনোনয়ন পেলেই নির্বাচিত।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে পরামর্শক ড. জাহিদ হোসেনের মতে, রাজনৈতিকভাবে বরাদ্দ ব্যবহার তো হচ্ছেই। বিশ্বব্যাংকের সাথে যেসব প্রকল্প স্থানীয় সরকারের রয়েছে তাতে প্রত্যেকটাতেই বিলম্ব আছে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অভিজ্ঞতা যা, স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে খুব একটা ভিন্নতা নেই বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে তারা হয়তো বলতে পারে অর্থ পেতে তাদের অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে হয়। অর্থ ছাড়েও অনেক দেরি হয়। এ ছাড়া এখানে যে দুর্নীতি নেই সেটা বলা যাবে না। কারণ কাজ করতেই তো বিলম্ব হচ্ছে। আর মাঠপর্যায়ে ভিন্ন রকমের ফলাফল তো দেখা যায় না। তিনি বলেন, এখানে ছোট ছোট ঠিকাদারদের কাজ দেয়া হয়। সেই কাজগুলো কারা পায় সবারই জানা। যে পরিমাণ অর্থ যায় সে পরিমাণ সুফল তো মানুষ পায় না। তার মতে, স্থানীয় সরকারগুলোর তো বেশি কিছু করণীয় থাকে না। সিটি করপোরেশনগুলো যদি দেখেন, তারা মশাকেও ঠিক মতো মারতে পারে না। ঢাকা সিটি নর্থের যা শুনেছি, দুটো কোম্পানির সাথে অনেক আগে চুক্তি করা আছে। তারাই সরবরাহ করবে। ওদের ওষুধের ভেজাল জনগণতো চোখের সামনেই দেখাতে পায়। মনে হয় মশাবান্ধব ওষুধ, মশা নিধন করবে তো দূরের কথা। তিনি বলেন,
এমনিতেই সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা খুব সীমিত। তারপরও দুর্নীতির কথাও শুনতে পাই। আর অদক্ষতা ও অকার্যকরতা তো আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই। অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। এখানে জনগণের সচেতনতার অভাব আছে ঠিকই। কিন্তু সিটি করপোরেশন জনগণের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

এডিপির অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে ড. জাহিদ বলেন, টাকা ছাড় যা হয় সেটা যে খরচ হয়েছে কি না সেটাও জানা যায় না। দেখা যায় সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) মূল এডিপির চেয়ে কম হয়। কিন্তু পরে যখন নভেম্বরে আমরা এডিপি পাই সেটা আরএডিপির তুলনায়ও অনেক কম থাকে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/502715/