২ এপ্রিল ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৩:৩০

বিশ্বে একদিনে মৃত ৪ হাজারের বেশি

* ৩ মাসে প্রাণহানি ৪৪ হাজার এবং আক্রান্ত প্রায় ৯ লাখ
* যুক্তরাষ্ট্রেই মারা যেতে পারে দুই লাখের বেশি
* প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু জাপানে
* করোনা শব্দ উচ্চারণ করলেই গ্রেফতার তুর্কমেনিস্তানে
স্টাফ রিপোর্টার : মহামারি করোনা ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭২ হাজার ৫শ ৬১ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। একই সময়ে প্রাণহানি হয়েছে ৪ হাজার ৩শ’ ৪১ জনের। ওয়ার্ল্ডোমিটারের সবশেষ তথ্য মতে করোনায় গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে একদিনে ২৩ হাজার ৯৪১ জনের দেহে করোনার উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। মারা গেছেন ৭শ’ ২৬ জন। বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করা করোনা ভাইরাসে ইউরোপে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। বুধবার বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে এই তথ্য।

কোভিড-১৯ এ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ইউরোপে মোট ৩০ হাজার ৬৩ জন মারা গেছে এবং আক্রান্ত হয়েছে চার লাখ ৫৮ হাজার ৬০১ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ইতালিতে। এ সংখ্যা ১২ হাজার ৪২৮ জন। স্পেনে আট হাজার ১৮৯ জন এবং ফ্রান্সে তিন হাজার ৫২৩ জন।

করোনায় গত এক মাসেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ইতালি। নতুন করে দেশটিতে ৪ হাজারেরও বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ১২ হাজার ৪শ ২৮ জনে দাঁড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৮শ’ ৩৭ জন। যুক্তরাষ্ট্রের পর করোনায় আক্রান্তে লাখের ঘর অতিক্রম করলো ইউরোপের দুই দেশ ইতালি ও স্পেন। ফলে মোট মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যায় তারা চীনকে ছাড়িয়ে গেলো। ইউরোপের দেশ স্পেনের করোনা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে করোনা ভাইরাসে মারা গেছে আরও ৮৬৪ মানুষ। আর বুধবার সকাল থেকে বেলা ৪টা পর্ন্ত সেখানে মারা গেছে ৪০০’র বেশি মানুষ। ফলে দেশটিতে করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪৬৪তে। দেশটিতে সমান তালে বাড়ছে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যাও। মঙ্গলবার সেখানে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রায় ৮ হাজার মানুষ (৭ হাজার ৯৬৭ জন)। বুধবার সকাল থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন স্পেনের ৬২১৩ জন। দেশটিতে কত দ্রুতগতিতে যে করোনা ছড়াচ্ছে এই সংখ্যাই তার প্রমাণ। এর ফলে দেশটিতে মোট আক্রান্ত ১ লাখ ছাড়িয়েছে। সেখানে মোট করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ২ হাজার ১৩৬ জন।

এদিকে, গত ৩ মাসে করোনার ছোবলে বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা ৪৪ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মোট ৪৪ হাজার ১শ ৬৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৪ হাজার ৩শ জনেরও বেশি। এদিকে মহামারী আকার ধারণ করা এ ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ লাখ ৮৪,০৭৫ জন-এ দাঁড়িয়েছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের সর্বশেষ তথ্য মতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭২ হাজার ৫শ’ ৬১ জনের নতুন আক্রান্তের ঘটনায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত মোট ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫ জনে দাঁড়িয়েছে।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসেবে, ১ লাখ ৮৫ হাজার ১৭৫ জন করোনা আক্রান্ত রোগী চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে ৩৩,৭৫৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। যা আক্রান্তের শতকরা ৫ ভাগ।

করোনা ভাইরাস মহামারিতে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই দুই লাখের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার আশঙ্কা করছেন দেশটির কর্মকর্তারা। মঙ্গলবার, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী দুই সপ্তাহের ‘কঠিন পরিস্থিতি’র জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউজের এক বিফ্রিংয়ে এ বিষয়ে বিশদ নির্দেশনা দেন তিনি।

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিফ্রিংয়ে হোয়াইট হাউসের করোনা টাস্কফোর্সের কর্মকর্তা ডা. ডেবোরা ব্রিক্স ও অ্যান্টনি ফাউসি আগামী দুই সপ্তাহে অন্তত এক লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা জানিয়েছেন। টাস্কফোর্সের কর্মকর্তাদের মডেল অনুযায়ী, এখন থেকে সকল নাগরিক সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলেও যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে এক লাখ থেকে দুই লাখ ৪০ হাজার পর্যন্ত মানুষ মারা যেতে পারেন। ডা. ডেবোরা ব্রিক্স আরও জানান, সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতা না মানা হলে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা ১৫ থেকে ২২ লাখে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।

এরপরই হোয়াইট হাউজের ব্রিফিংরুমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘আমি চাই প্রত্যেক মার্কিন নাগরিক কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকুক। আগামী দুই সপ্তাহ আমাদেরকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।'

এর আগে গত ২৯ মার্চ দেশটির জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অ্যান্টনি ফাউসি করোনা মহামারি যুক্তরাষ্ট্রে দুই লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এরপরই আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার ঘোষণা দেন ট্রাম্প।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ আক্রান্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬৭৯।

ভারতের উত্তর প্রদেশের ৪০ নাগরিক বর্তমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি শি জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন। গতকাল বুধবার এ খবর জানিয়েছে ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য মিন্ট। মামলার বিবরণীতে- নভেল করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়াতে দিয়ে কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন করার অভিযোগে শি জিনপিংকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে উত্তর প্রদেশ পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মামলার কপি তারা হাতে পেয়েছেন, যেহেতু এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিষয় জড়িত তাই সবদিক বিবেচনা করে আইন অনুসারে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, নেপালের কয়েকজন নাগরিক এর আগে একই ধরনের অভিযোগে শি জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের করেছে।

করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাঝেই অনেকটা আশার আলো দেখালো জাপানের ফুজি ফিল্ম। এই মরণ ভাইরাসের চিকিৎসায় তারা নিজেদের অ্যাভিগান ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছেন। অ্যাভিগানের জেনেরিক নাম ফ্যাভিপিরাভির। সাধারণত, ঠান্ডা, কিংবা সর্দি-কাশির চিকিৎসায় ওধুষটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি চীনে করোনার চিকিৎসায় ওষুধটি অবিশ্বাস্য সফলতা দেখায়। চীনের চিকিৎসকরা পরীক্ষামূলকভাবে যেসব করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এই ওষুধ প্রয়োগ করেছেন তারা তুলনামূলক অন্য রোগীদের চেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়েছেন। এ থেকেই এই ওষুধে আশা দেখছে ফুজি ফিল্ম।

গতকাল ফুজি ফিল্মের এক মুখপাত্র ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘আমরা প্রথমে তথ্য সংগ্রহ করবো। এরপর সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে অনুমোদনের জন্য আবেদন করবো। সামান্য নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ২০ থেকে ৭৪ বছর বয়সী রোগীদের সর্বোচ্চ একদিনের জন্য ওষুধটি দেয়া হবে। প্রাণীর শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগের পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। তাই এটি অন্তঃসত্ত্বা নারীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে না।’ আসছে জুনের শেষ নাগাদ অন্তত ১০০ জন রোগীর শরীরে এই অ্যাভিগান পরীক্ষামূলকভাবে ট্রায়াল করতে চায় ফুজি ফিল্ম। অ্যাভিগান সম্পর্কে গেল শনিবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বলেছেন, ‘আমরা করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা হিসেবে অ্যাভিগানের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করবো।’ এরইমধ্যে গেল মাসেই অ্যাভিগানের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হয়েছে বলে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। জাপানেও দুই ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গেছে, অ্যাভিগান কোনও রোগীকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম। যদিও তখন ওই ট্রায়ালে ফুজি ফিল্ম যুক্ত ছিল না। এবার তারা তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালটি করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তান দাবি করছে সেখানে কোনো করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি। কিন্তু কেউ যদি প্রকাশ্য স্থানে করোনা ভাইরাস শব্দটি উচ্চারণ করেন, তাহলে তার গ্রেপ্তার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কেননা দেশটির শাসক গার্বাঙ্গুলি বার্দিমুখাবেদভ এই শব্দটি নিষিদ্ধ করেছেন। রিপোর্টার উইদাউট বর্ডারের বরাতে এ খবর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এনপিআর। খবরে বলা হয়, ২০০৬ সাল থেকে তুর্কমেনিস্তান শাসন করছে বার্দিমুখাবেদভের কর্তৃত্ববাদী সরকার। দমনপীড়নমূলক শাসন ব্যবস্থা কায়েম থাকায় সেখানে সংবাদ মাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা নেই। গুটিকয়েক স্বতন্ত্র সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে ক্রনিকলস অব তুর্কমেনিস্তান নামে একটি ওয়েবসাইট। ওয়েবসাইটটিতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, সরকার রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমকে করোনা ভাইরাস শব্দটি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতাল, স্কুল ও অফিসে বিতরণকৃত পুস্তিকা থেকেও শব্দটি সরানোর নির্দেশ দিয়েছে।

রেডিও ফ্রি ইউরোপের প্রতিনিধিরা জানাচ্ছেন যে, জনসম্মুখে এই রোগ নিয়ে আলোচনা করলে, এমনকি মুখবন্ধনী পরিধান করলেও লোকজনকে আটক করছে সাদা পোশাকের পুলিশ। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া ডেস্কের প্রধান জিয়ান ক্যাভিলিয়ের বলেন, “তথ্য বাধাগ্রস্ত করার ফলে তুর্কমেন নাগরিকরাই কেবল ঝুঁকিতে পড়ছে না, এতে করে প্রেসিডেন্ট গুর্বাঙ্গলি বার্দিমুখামেদভের কর্তৃত্বই প্রবলভাবে ফুটে উঠছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া আশা করছি। আহ্বান জানাচ্ছি, তার পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।” তুর্কমেনিস্তানের দক্ষিণের প্রতিবেশী ইরান করোনা ভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলোর অন্যতম। দেশটির আশেপাশের মধ্য এশিয়ার অন্যান্য বহু দেশে শত শত করোনা আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যারিম্যান ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও মধ্য এশিয়া রাজনীতির বিশেষজ্ঞ আলেক্সান্দার এ. কুলি বলেন, তুর্কমেনিস্তান হলো এমন এক জায়গা যেখানে কথার বলার জন্য শাস্তি জোটে। সরকার কোনো কারণ ছাড়াই দেশ অচল করে দেয়। তিনি বলেন, ‘করোনা ভাইরাস শব্দটি নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপকে নগ্ন ও চরম মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশটির সকল মিডিয়া ও ডিজিটাল মাধ্যম রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে। সেই হিসেবে এই পদক্ষেপ তেমন ভয়াবহ কিছু নয়। আমার অনুমান হচ্ছে, তারা এই মহামারির কথা যতদিন পারবে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে।’

http://dailysangram.info/post/412101