১ এপ্রিল ২০২০, বুধবার, ৯:১৪

রাজধানীর সড়কে গণপরিবহন নেই ॥ সীমিত পরিসরে চলছে ব্যক্তিগত গাড়ি-রিকশা

দূরত্ব বজায় না রেখে এভাবে চলাচল ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর শনিরআখড়া এলাকা থেকে তোলা ছবি -সংগ্রাম

বিশ্বজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করেছে করোনা ভাইরাস। বাংলাদেশে গতকাল মঙ্গলবারও দুজন নতুন করে করোনায় আক্রান্তের খবর মিলেছে। তবে ছুটি বর্ধিতের ঘোষণা দিলেও গণপরিবহন সীমিত আকারে চলাচল করবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে অনেক জেলাতে কোয়ারেন্টাইন মেনে চলছেন না সাধারণ মানুষ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হলেও তার ব্যাত্যয় ঘটছে অহরহ। হাটবাজারে জনসমাগম বেড়ে গেছে। কোয়ারেন্টাইন না মানা জেলাগুলোতে ডিসি’র নেতৃত্বে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। তারা মাইকিং করে নির্দেশনা মানার তাগিদ দিচ্ছেন।

গতকাল মঙ্গলবার গণভবন থেকে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছুটি বর্ধিতের ঘোষণার পাশাপাশি সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচলের কথা জানান। এ সিদ্ধান্তের ফলে রাস্তাঘাটে জনসমাগম বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জনসমাগম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছেন।

তবে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর শ্যামলী, মিরপুর, কল্যাণপুর, ষাটফিট পীরেরবাগ, আগারগাঁওয়ের মতো বেশকিছু ব্যস্ততম সড়কে দেখা গেছে, গণপরিবহন চলছে না। সড়কে পরিবহন চলাচলের সংখ্যা হাতেগোনা পর্যায়ে। যেসব চলছে তার মধ্যে ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, পণ্যবাহী পিকআপ, ট্রাকের সংখ্যাই বেশি। তবে সড়কে রিকশা চলছে হরহামেশা।

ষাটফিটে দেখা যায়, লেগুনা ও পিকআপ ভ্যান সারি সারি দাঁড়িয়ে। ২-১টা পিকআপ পণ্য পরিবহন কাজে চললেও বন্ধ মিরপুর-২ থেকে ফার্মগেটগামী লেগুনা। গণপরিবহনের দেখা নেই। জরুরি কাজে ঘর থেকে বেরিয়ে সড়কে আসা অধিকাংশ মানুষই চলছেন রিকশায়।

শামিম হাসান নামে এক পথচারী জানান, দারুসসালাম এলাকা থেকে কখনো আগারগাঁও যেতে রিকশায় বা হেঁটে যেতে হয়নি, বাসেই যাতায়াত করি। কিন্তু শিশু হাসপাতালে চাকরির সুবাদে ছুটির মধ্যেও হাসপাতালে ডিউটি করতে হচ্ছে। বিকেলের শিফটের ডিউটি ধরতে আগেভাগেই বেরিয়ে পড়েছি। রিকশাও মিলছে না। তাই হেঁটেই চলছি গন্তব্যে।

মগবাজার এলাকার রিকশাচালক সুজন মিয়া বলেন, বাস চলতাছে না। কিন্তু রিকশা চলতে দিতাছে। লোকজন খুব একটা বের হচ্ছে না। ভাড়ার অভাব আছে। করোনার ঝুঁকি পাত্তা দিলে পেটে ভাত জুটবে না। তাই ফাঁকা রাজধানীতে বেশি বেশি রিকশার প্যাডল ঘুরাইয়ে বেশি ভাড়া মারার চেষ্টা করছি।

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সে ছুটি বর্ধিত করে করা হয়েছে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। এ ব্যাপারে ভিডিও কনফারেন্সে গতকাল প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছুটি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সীমিত আকারে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর জন্য আমরা চিন্তা-ভাবনা করে বলব, কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা সেটা ছাড় দেব, চালু রাখা দরকার। তিনি বলেন, পরিবহন শ্রমিক শ্রেণি যারা আছেন তারাও যাতে কষ্ট না পায় তাদের তালিকা আমি ইতোমধ্যে করতে বলেছি। তাদের যেভাবে সাহায্য দরকার, আমরা সেই সাহায্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবো।

রাজধানীতে ৭ দিন ধরে জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছে পুলিশ : করোনা ভাইরাস থেকে রাজধানীবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গত সাতদিন ধরে জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। গতকালও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটিয়েছে ডিএমপি।

গত ২৫ মার্চ থেকে নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রতিদিন ডিএমপির আটটি ওয়াটার ক্যানন আট ক্রাইম বিভাগের (রমনা, তেজগাঁও, লালবাগ, ওয়ারী, মিরপুর, গুলশান, উত্তরা ও মতিঝিল) বিভিন্ন স্থানে প্রথমে সকাল ১০টা হতে ১২টা পর্যন্ত জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটানো শুরু হয়। পরে দ্বিতীয় দফায় বিকেল ৪টা হতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।

নির্দেশনা অমান্য করে পাবনার হাটবাজারে হাজারো মানুষ: পাবনার হাটবাজারে জনসমাগম বন্ধ করা যাচ্ছে না। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জেলার বড় বড় হাটবাজারে জনসমাগম হচ্ছে হাজারো মানুষের। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সরকার বিশেষ কয়েকটি পণ্যের দোকান ছাড়া হাটবাজার বন্ধের নির্দেশ দিলেও পাবনার এসব হাটবাজারে নিয়ম মানা হচ্ছে না। আগের মতোই হাটবাজারে কেনাবেচা হচ্ছে সব ধরনের পণ্য। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব হাটে সমাগম হচ্ছে হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার। এমনকি হাটে আসা ৯৫ ভাগ মানুষই মাস্ক ছাড়াই অবাধে চলাফেরা করছেন।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জরুরি ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট, সরকারি-বেসরকারি অফিস, পরিবহন বন্ধের ঘোষণা দেয়। অতিরিক্ত জনসমাগমকেও নিরুৎসাহিত করা হয়। সামাজিক দূরত্বসহ নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনার কথা বলা হয়। সরকারের এ কাজ বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

তবে জেলার বড় বড় হাটে কেনাবেচা হচ্ছে আগের মতোই। এসব হাটে সমাগম হচ্ছে হাজারো মানুষের। প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাটবাজার ইজারাদার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বলা হলেও নিয়ম মানেনি তারা। ফলে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমাগমে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীসহ সচেতন মহল।

সুজানগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, হাটবাজারসহ যেকোনো জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বলা হলেও কেউ তা মানছে না। গ্রামীণ হাটবাজারে ব্যাপক সমাগম করোনা সংক্রমণের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।

একই অবস্থা বগুড়াতেও। করোনা পরিস্থিতিতে কঠোর বিধি নিষেধের মধ্যেও বগুড়ায় ঘরে থাকছে না মানুষ। ভিড় করছে শহরে। রিকশা, ভ্যান, সিএনজি, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছেন তারা। গতকাল মঙ্গলবার শহরের প্রধান সড়ক ও অভ্যন্তরীণ সড়কে যানবাহন চলাচল করেছে। পাড়া-মহল্লা ও বাজারগুলোতে ছিলো স্বাভাবিক সময়ের মতোই ভিড়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনার ভয়াবহতা বগুড়ার মানুষ এখনো আচঁ করতে পারেনি। এ কারণে স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হলেও কর্মহীন দরিদ্রদের সঙ্গে সাধারন মানুষও তা মানছে না।

টানা পাঁচদিন এক রকম গৃহবন্দি থাকা বগুড়া শহরবাসীর অনেকেই মঙ্গলবার সকাল থেকে হঠাৎ বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। শহরের জিরো পয়েন্ট সাতমাথা, পার্করোড, খান্দার মোড়, শেরপুর রোড, স্টেশন রোড, কাজী নজরুল সড়ক, থানা রোড, বড়গোলা টিনপট্টি, কালীতলাসহ শহরের ছোটবড় সব সড়কেই ছিল লক্ষ্য করার মত যানবহন ও মানুষের ভিড়। বাজারগুলোতেও ছিল স্বাভাবিক সময়ের মত ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম। এছাড়াও ওষুধের দোকান, গৃহ নির্মাণের সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর দোকানেও ক্রেতাদের সমাগম ছিল স্বাভাবিক।

পাইকারি কাঁচা বাজার রাজাবাজারের সামনে কেনাকাটা করতে আসা মানুষের রীতিমতো ভিড় লেগে গেছে। এছাড়া ঝাউতলা ও খান মার্কেটে ওষুধের পাইকারি ও খুচরা দোকান এবং বিভিন্ন ব্যাংকগুলোতেও মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

এদিকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসাকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে জনগনকে আরও সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনকে আরও তৎপর হওয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বগুড়া সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বদিউজ্জমান জানান, পুলিশ নমনীয়ভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে মানুষকে ঘরে পাঠাচ্ছে। কিন্তু অনেকেই সচেতন নয়। এসব মানুষকে নিয়েই এক রকম ঝুঁকি দেখা দিয়েছে এখন।

শহরের ভিড় প্রসঙ্গে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মেদ বলেন, জনগণকে সচেতন করতে আমাদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন তৎপর রয়েছে। তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।

ঘরবন্দী মানুষের জন্য রাজশাহীতে ভ্রাম্যমাণ বাজার: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে বাড়ির বাইরে বের না হওয়ার নির্দেশ জারি রয়েছে রাজশাহীতেও। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কাজ করছে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ। এই পরিস্থিতিতে ঘরবন্দী মানুষের দরজায় সবজিবোঝাই ট্রাক নিয়ে হাজির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে তারা পরীক্ষামূলকভাবে নগরীর রাজারহাতা ও কাদিরগঞ্জ এলাকায় সবজি বিক্রি করেছে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে নগরবাসীর বাজারে গমন নিরুৎসাহিত করতে এ ভ্রাম্যমাণ বাজার নামানো হয়েছে। এতে সহায়তা করছে জেলা প্রশাসন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক শামসুল হক বলেন, প্রথম দিন পরীক্ষামূলকভাবে ৩০০ কেজি সবজি নামানো হয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে গেছে। আজর বুধবারও একইভাবে সবজির ভ্রাম্যমান বাজার নামানো হবে।

এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সাতক্ষীরায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী। মানুষ যেন প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে ঘোরাফেরা না করে সেটি তদারকি করছেন জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল। সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে শহরের বিভিন্ন সড়কে মাইকিং করেন তিনি।

এ সময় জেলা প্রশাসক সবাইকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হবেন না। খেটে খাওয়া দুস্থ মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা ঘরে থাকুন। আপনাদের যেন কষ্ট না হয় সেজন্য সরকার খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। ঘরের বাইরে এসে বিপদ ডেকে আনবেন না।

http://dailysangram.info/post/411956