৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:০২

কমছে নির্দেশনা মানার প্রবণতা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানানোর পরও অনেকেই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে নিরাপদ দূরত্ব মানছে না। ছবিটি গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে তোলা। ছবি : কালের কণ্ঠ

সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর গত চার দিনের চেয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে গতকাল সোমবারের চিত্র ছিল একেবারেই ভিন্ন। মূল সড়কগুলোতে লোকজনের আনাগোনা কম থাকলেও অলিগলিতে ভিড় বাড়ছে। খুলতে শুরু করেছে বেশির ভাগ চায়ের দোকান ও অন্য ছোটখাটো দোকান। কাঁচাবাজারেও মানুষের ভিড় বেড়েছে। কাজের সন্ধানে বেরিয়েছে নিম্ন আয়ের অনেক লোকজন। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও আগের চার দিনের চেয়ে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশা ছিল বেশি। তবে বিপণিবিতানসহ বড় বড় সব দোকানই বন্ধ ছিল। আর ঢাকা থেকে অনেক লোকজন গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় সেখানকার হাট-বাজারগুলো ছিল বেশ জমজমাট।

গতকাল রাজধানীর মিরপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মূল সড়কে কিছু সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে। রিকশার আধিক্যও ছিল। কিছু ব্যক্তিগত যানবাহনও চলছে। রাস্তায় বের হওয়া মানুষজন কেউ বলেছে তারা বাজার করতে, কেউ ব্যাংকে টাকা তুলতে, কেউ ওষুধ কিনতে বা কেউ প্রয়োজনীয় অন্য কিছু কিনতে বের হয়েছে। কিন্তু একসঙ্গে একাধিক লোকজন চললেও তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছিল না। গল্প করতে করতে হাঁটতেও দেখা যায় অনেককে। অলিগলিতে চায়ের দোকানে অনেকে আড্ডাও দিচ্ছিল। ভাসানটেক এলাকায় অনেক লোককে একসঙ্গে বসে গল্প করতেও দেখা গেল।

রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের মেম্বারবাড়ি জামে মসজিদের সামনে ছোট রেস্টুরেন্ট চালান আফজাল মিয়া। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা এবং ঘরে থাকার সরকারি নির্দেশনার পর গত বৃহস্পতিবার থেকে তিনি দোকান বন্ধ রেখেছিলেন, কিন্তু গতকাল তিনি দোকান খুলেছেন। আফজাল মিয়া বলছিলেন, ‘পাঁচজনের সংসার, দোকানভাড়া, বাড়িভাড়া, একজন কর্মচারীর বেতন, দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়াসহ পুরো সংসারের খরচ আমাকে চালাতে হয়। চার দিন যে হোটেল বন্ধ রেখেছি, তাতে অনেক কষ্ট হয়ে গেছে। মাল কেনার টাকা ভেঙে ভেঙে খেয়েছি।’

গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ পৌরসভাসংলগ্ন আদমপুর বাজার বেশ জমজমাট দেখা গেল। অধিকাংশ ক্রেতা মাস্ক না পরেই এসেছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার জট লেগেই ছিল। এ ছাড়া উদ্ববগঞ্জ বাজার, বৈদ্যের বাজার, শান্তির বাজারসহ সোনারগাঁর প্রতিটি বাজারেই ছিল মানুষের ভিড়।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশা চলাচল বেড়েছে। অনেকেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য বের হচ্ছে। তবে কেউ কেউ ফাঁকা নগরী ঘুরে দেখার জন্যও বের হচ্ছে। তাদের মধ্যে প্রভাবশালী কিছু পরিবারের সদস্যও রয়েছে, যারা নিজদের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সড়কে নেমেছে। এ ছাড়া সড়কে ভ্যান নিয়ে সবজি ও ফলমূল বিক্রেতাদের উপস্থিতি বেড়েছে। বিভিন্ন স্থানে দু-তিনটি করে ভ্যান দাঁড়িয়ে অস্থায়ী বাজারের মতো তৈরি করতেও দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘আগের দিনের চেয়ে সড়কে গাড়ি কিছুটা বেড়েছে। আমরা লোকজনকে বুঝিয়ে প্রথমে বাসায় ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করব। এর পরও যদি কেউ পুলিশের অনুরোধ উপেক্ষা করে, তাহলে আইন প্রয়োগ করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না।’

রাজশাহীতে ধীরে ধীরে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। বিশেষ করে নগরীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অটোরিকশাচালক আকবর হোসেন বলেন, ‘অটো না চালালে খাবার দিবে কে? তাই বাধ্য হয়ে অটোরিকশা নিয়ে নেমে পড়েছি। তবে যাত্রী বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।’

লক্ষ্মীপুরে রিকশাচালকদের খাদ্যসামগ্রী দিচ্ছে পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু তারা খাদ্যসামগ্রীও নিচ্ছে আবার রিকশাও চালাচ্ছে। আর স্থানীয় লোকজন বাড়ি ফেরায় পাড়া-মহল্লায় বাড়ছে ‘গণজমায়েত’। সকালে বাজার ও দোকানগুলোতে লোকজন কিছুটা কম থাকলেও বিকেলে তৈরি হয় ঈদের আমেজ। দোকানের অর্ধেক শাটার খোলা ও প্রশাসনের টহলের খবরাখবর রেখে দোকান খুলছেন ব্যবসায়ীরা। সিএনজিচালিত অটোরিকশাও চলাচল করতে দেখা গেছে।

জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল বলেন, ‘মানুষ সচেতন হলেই জনসমাগম ও অপ্রয়োজনে চলাচল বন্ধ করা সম্ভব। তা না হলে জেলা প্রশাসনের পক্ষে এটি রোধ করা কষ্টকর।’

হবিগঞ্জেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা ইজি বাইক চলাচল করছে। বাজারগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। দোকানে বসে একসঙ্গে নাশতা করছে লোকজন। শহরের কোর্ট স্টেশন এলাকার চাষিবাজারে শত শত মানুষ ভিড় জমালেও অধিকাংশ লোকের মুখে মাস্ক ছিল না। শায়েস্তানগর বাজারের মাছের বাজারেও ছিল লোকজনের ভিড়।

হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) অমিতাভ পরাগ তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লোকজনক আমরা সচেতন করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। তার পরও কিছু মানুষ নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করছে।’

টাঙ্গাইল শহরে সামাজিক দূরত্ব অনেকটাই পালন করা হচ্ছে। দিনের বেলা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সাধারণ রিকশা মাঝেমধ্যে চলাচল করছে। রাতে সে সংখ্যা খুব কমে যায়। গণপরিবহন, দোকান, শপিং মল বন্ধ রয়েছে। তবে গ্রামাঞ্চলে সামাজিক দূরত্ব ঢিলেঢালাভাবে পালন করা হচ্ছে। হাট-বাজারে লোক সমাগমও হচ্ছে।

নড়াইল শহরে অন্য দিনের তুলনায় গতকাল বেশি ইজি বাইক চলাচল করতে দেখা গেছে। লোকজন সামাজিক দূরত্বও মেনে চলছে না। তবে পুলিশ, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনতা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গতকাল বেশির ভাগ বাজার এলাকায় দোকানপাট খোলা দেখা গেছে। মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস না চললেও অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে উপজেলার সফিপুর বাজার, হরিণহাটি, পল্লী বিদ্যুৎ, কালিয়াকৈর বাজার, মাটিকাটা রেললাইন বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় লোকসমাগম ছিল বেশি।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার হাট-বাজার ও রাস্তাঘাটে গতকাল অনেক লোক দেখা গেছে। অধিকাংশ হাট-বাজারের দোকানপাট খোলা রয়েছে। রাস্তায় ভ্যান, ইজি বাইকসহ ছোট ছোট পরিবহন চলেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন মাইকিং করছি। দিনমজুরদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছি। তার পরও প্রয়োজন ছাড়া অনেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে।’

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বাজারগুলোতে প্রতিদিনই নির্দেশনা উপেক্ষা করে কেনাকাটা চলছে। বাজারগুলোতে মানুষের ভিড় লেগেই আছে।

কুড়িগ্রামের উ?লিপু?রে প্রশাস?নের পক্ষ থে?কে নানা উ?দ্যোগ নি?লেও তা কা?জে আস?ছে না। গ্রামের হাট-বাজারগু?লো?তে ভিড় বাড়ছে। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও দাওয়াত খেতে যাচ্ছে অনেকে।

বাগেরহাটের শরণখোলায় হাট-বাজার, রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। গতকাল সকাল থেকেই উপজেলা সদরের রায়েন্দা বাজার ও পাঁচরাস্তা মোড়ে ব্যাপক মানুষের সমাগম দেখা গেছে। সকাল ১১টার দিকে শেরেবাংলা সড়ক, ডাকবাংলোর সমানে এবং মাছ ও কাঁচাবাজারে অটোভ্যান, ইজি বাইক আর মানুষের জটলা সৃষ্টি হয়।

শরণখোলা থানার ওসি এস কে আব্দুল্লাহ আল সাইদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে করোনাবিষয়ক সতর্কতামূলক প্রচার-প্রচারণা নিয়মিত চলছে। তার পরও মানুষ বাইরে বেরুনোর চেষ্টা করছে।’

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন হাট-বাজার ও উন্মুক্ত স্থানে মানুষের ঘোরাফেরা চলছেই। রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল দেদার চলছে।

চুয়াডাঙ্গায় ভিড় ছিল কাঁচাবাজার, মাছ ও মাংসের বাজারে। অনেকে এক স্থানে বসে জটলা করে আলোচনাও করছিল। জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘বাজারে এসে কেনাকাটার জন্য তিন ফুট দূরত্বে রেখা টেনে দিয়েছি। তার পরও কোনো কাজ হচ্ছে না।’

বরিশালের গৌরনদীতে পুলিশ চলে গেলে আবার লোকসমাগম শুরু হচ্ছে। বাজার ও গ্রামের চায়ের দোকানে সন্ধ্যা হলেই ভিড় বাড়তে থাকে। উপজেলায় বিদেশফেরত ৫৪১ প্রবাসীর মধ্যে হোম কোয়ারেন্টিনে আছে ১২৩ জন। পাসপোর্টে গৌরনদীর ঠিকানা ব্যবহার করে বিদেশফেরত ৪১৮ প্রবাসীর সন্ধান মেলেনি। হোম কোয়ারেন্টিনে অবস্থানরতরাও সরকারি নির্দেশনা ঠিকভাবে মানছে না।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/03/31/892819