৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১১:২৮

থমকে গেছে ঢাকার খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা

ইবরাহীম খলিল : করোনা ভাইরাসের কারণে হুমকির মুখে বিশ্ব অর্থনীতি। অনেকটা থমকে গেছে ঢাকার খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা। এ অবস্থায় পঞ্চমদিনের কর্মহীন সময় কাটালেন এসব মানুষ। কোথায়ও লোকজনের তেমন ভিড় নেই, চলাচলও সীমিত। বাস, নৌযান, কল-কারখানাসহ বন্ধ দোকানপাটও। নেই হকার, কুলি ও বাসস্টাফদের হাঁক ডাক। করোনার প্রকোপ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষকে ১০ দিনের জন্য ঘরে অবস্থান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী নগরবাসী ঘরে অবস্থান করেছেন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে কেউ বের হচ্ছেন না। তীব্র যানজটের নগরী এখন প্রায় ফাঁকা ও নীরব নিস্তব্ধ। এতে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়েছেন দিনমজুরসহ নিম্ন-আয়ের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষেরা।

সোমবার করোনা পরিস্থিতিতে ছুটির পঞ্চমদিনে রাজধানীর পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং খেটে খাওয়া কর্মহীন এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার জন্য ব্যবসানির্ভর এসব এলাকাসহ পাড়া মহল্লার দোকানপাটও বন্ধ। নেই চিরচেনা চায়ের আড্ডাও। তবে সকালে দু-একটি দোকান কিছু সময়ের জন্য খোলা রাখা হয়। যাতে এলাকাবাসীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারে। দোকানপাট বা বাজারের আশপাশে কিছু মানুষের হঠাৎ দেখা মিললেও তা অন্যান্য সময়ের তুলনায় একেবারেই নগন্য। রাস্তায় গাড়ি বলতে দেখা গেছে ছোট ছোট পিকআপ ভ্যান। তবে তাও সংখ্যায় হাতে-গোনা।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা শোভন লাল সাহা জানালেন, করোনার ভয়ে আমাদের এলাকায় সকাল থেকে কেউ বাইরে যাচ্ছে না। সবাই বাসায় অবস্থান করেছেন। আমরাও ভাই-বোন সবাই বাসায় অবস্থান করছি। গত পাঁচদিন জরুরি প্রয়োজন যেমন- বাজার করা ছাড়া কেউ বাইরে যাইনি। এছাড়া এলাকার প্রতিটি বাসিন্দা বাসায় অবস্থান করেছেন। আমাদের এলাকা একদম নীরব ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। একই কথা রিকশাচালক রাসেলের মুখেও। তবে যাত্রী কমে যাওয়ায় সংসারের খরচ চালাতে যে তার হিমশিম খেতে হয়েছে তা নিয়েও চিন্তিত তিনি।

রিকশাচালক রাসেল জানান, ‘পয়লা চারদিন বাসায় আছিলাম। সংসার তো চলে না। খাইয়া বাঁচন লাগবো তো। এরপর আর থাকার সিস্টেম নাই। আমার সংসার চলে গাড়ি চালাইয়া। তাই করোনার ঝুঁকি থাকলেও পেটের দায়ে রাস্তায় নামছি রিকশা লইয়্যা। রিকশাচালক মো. হাবিব জানালেন, ঢাকা শহরের চিরচেনা রাস্তা যেন এখন অচেনা লাগে। এ অবস্থায় আয়-রোজগার একেবারেই কম। তিনি বলেন, সকাল ৮ টায় রিকশা লইয়া বের অইছি। দুপুর ১২ টা বাজে। ৪ ঘণ্টায় মাত্র ৮০ টাকার খেপ (ভাড়া) মারছি। করোনার জন্য মানুষ বাইরে বাহির অয় না। জরুরি যেসব দোকানপাট বাজার খোলা রাখার কথা তারও বেশিরভাগ বন্ধ। হাবিব জানালেন, ২৫ / ৩০ টাকার তিনটি ট্রিপ দিয়ে ৮০ টাকা পেয়েছন। এই ছুটি ঘোষণার আগে একই সময়ে আয় হতো ৩০০-৩৫০ টাকা।

২১ বছরের তরুণ আমিন উদ্দিন ঢাকায় একটি গণপরিবহনের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু করোনার কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন কর্মহীন হয়ে পড়েন। বললেন, পাঁচদিন ধরে কাজ নাই। হাতেও টাকা নাই। এখন না খেয়ে থাকার অবস্থা হয়েছে।

২০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাটে খেয়া পারাপার করেন আবদুর হালিম। তিনি জানান, একদিন কাজ করতে না পারলেই পরিবারের লোকজন কী খাবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যেতে হয়। করোনার কারণে বেশ কয়েক দিন ধরে কাজ করতে পারছেন না। তাই আয়ও নেই। এ অবস্থায় না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়েছে তার। ‘আগে দিনে সব খরচ বাদ দিয়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হইতো। এখন সেখানে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা অইতাছে। তা দিয়ে বাসা ভাড়া, সংসার খরচ চালানো অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। হুনছি (শুনেছি) সরকার দিন মজুরদের লাইগ্যা সাহায্য দিবো। কিন্তু দিবো কিভাবে? আমরা তো হারাদিন-ই নৌকা চালাই। সাহায্যের জন্য তিন চাইর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াইবো কে?’ তিনি বলেন, লাইনে দাঁড়াইয়াও পাওয়া যায় না। অহন তো নৌকা চালাইয়া কিছু পাইতাছি। তহন না পাইলে তো দুই দিকই যাইবো। তাই সরকারের সাহায্য যাতে আমরা পাই সেইডা নিশ্চিত করন লাগবো।

রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেকপোস্ট। অপ্রয়োজনে মানুষজন যেন রাস্তায় ঘোরাঘুরি না করে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন তারা। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও প্রয়োজনীয় পণ্যবাহী ট্রাক, জরুরি ওষুধ সরবরাহকারী পিকআপ ভ্যান ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করতে পারছে।

করোনা পরিস্থিতির কারণে বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। কয়েকদিন কাজকর্ম বন্ধ থাকায় মানুষদের মাঝে খাবারের জন্য শুরু হয়েছে হাহাকার। আনন্দ বাজারে ফুটপাতে পিঠা বিক্রেতা ছালেহা বেগম জানান, সন্তান পেটে থাকতে স্বামী মারা গেছেন। বৃদ্ধ শশুর- শাশুড়ি আ র সন্তান নিয়েই বস্তিতে থাকেন। তার আয় দিয়েই চলে সংসার। বছরের বেশি ভাগ সময় পিঠা বিক্রি করেন। অন্য সময় বাসা বাড়িতে কাজ করেন। এখন করোনা ভাইরাসের কারণে পিঠাও বিক্রি করতে পারেন না। করোনার ভয়ে বাসা বাড়িতেও কেউ কাজে নেয় না। এমন ভাবে চলতে থাকলে মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। শুনেছি চাউল, ডাল দেয়। আমরা তো পেলাম না। চা বিক্রেতা হালিম জানান, দিনে যা রোজগার হয় তা দিনেই শেষ হয়ে যায় । যেটা জমানো হয় সেটা দিয়ে বাসা ভাড়া দেই। করোনাভাইরাসের কথা শুনেছি। সরকার যদি আমাদের সহযোগীতা করেন। বাড়ি ভাড়া ১/২ মাস ফ্রি করে দিতেন তাহলে আমরা বাড়িতে থাকতে পারতাম। এখন পেটের জ্বালা আর থাকার জন্য ঝুঁকি নিয়ে চা বিক্রি করি। কাষ্টমার ও এখন অনেক কম। ভয়ে কেউ চা খেতে চান না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আমাদের বিপদের সময় এগিয়ে আসলে কষ্ট কিছুটা হলেও কমে যেত।

এদিকে সরকারি ছুটি ঘোষণার পর দুই দিনেই অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে নগরের অধিকাংশ সেলুনকর্মীদের। যখন হাতে অফুরন্ত কাজ ছিল তখনও কোনোমতে খেয়ে পড়ে থাকতেন তারা। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তার ভাজ পড়েছে তাদের কপালে। আরও কয়েকদিন গেলে কীভাবে তারা পরিস্থিতি সামাল দেবেন এই নিয়ে তারা মহাদুশ্চিন্তায় আছেন।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশে কার্যত লকডাউন অবস্থা চলছে। এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়ার কথা থাকলেও আবার লকডাউনের মেয়াদ বাড়তে পারে। এই দীর্ঘ সময়ে কাজ না থাকায় কপালে দুশ্চিন্তার পড়েছে নাপিতদের। কারণ অধিকাংশ নরসুন্দর মহল্লার ছোট ছোট সেলুনে কাজ করেন। কাজ হলে টাকা পান, নতুবা না। মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ হাউজিং এলাকার এক সেলুনে কাজ করেন নাদিম। তিনি বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত। বসবাস করেন জেনেভা ক্যাম্পে।

নাদিম বলেন, ‘দুই দিনেই অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। কোনো রকম খাইয়া, না খাইয়া আছি। বাকি দিনগুলাতে কি করব বুঝতেছি না।‘ মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের ৩ নম্বর সড়কের একটি সেলুনে কাজ করেন মোহাম্মদ কলিম। এই উর্দুভাষী থাকেন কৃষি মার্কেট টোল ক্যাম্পে। তিনি জানান, জমানো টাকা দিয়ে আগেই বাজার করে রেখেছিলেন। যা আর দুই থেকে তিন দিন চলতে পারে। এরপর কি করবেন, সে বিষয়ে ধারণা নেই তার।

হতাশা প্রকাশ করে কলিম বলেন, ‘কি করোনা আইল, কাজকাম বন্ধ। কোনোভাবে খাইয়া, না খাইয়া আছি। দুই দিনের বাজার আছে। তারপর বউ বাচ্চা নিয়া কি খামু? ক্যাম্পে কারও থেকে ধার নিমু সে সুযোগও নাই। যারা কাজ করে, সবার একই অবস্থা। কারো কাছে হাত তো পাততে পারি না ভাই। আমরা কাজ করার লোক।‘

অনেক সেলুনের কর্মচারী নিষেধাজ্ঞা পেতেই ঢাকা ছেড়েছেন। কর্মচারীরা বলছেন, এসব সেলুনের মালিকরা সঠিক সময়ে ঢাকায় না ফিরলে তাদের সমস্যা আরও বাড়তে পারে। এদিকে খাবারের চিন্তা তেমন নেই সেলুন মালিকদের। তবে তাদের কপাল কুচকে আছে দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ ও পানির বিলের কারণে। দশ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হতে হতে খরচের খাতা খুলবে।

http://dailysangram.info/post/411852