৩০ মার্চ ২০২০, সোমবার, ১:০৯

সন্দেহ-শঙ্কায় সব রোগের চিকিৎসাই ব্যাহত হচ্ছে

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সারা দেশে চলছে অঘোষিত লকডাউন। টানা ১০ দিনের ছুটির পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানাভাবে সতর্ক করা হচ্ছে মানুষকে। এমন পরিস্থিতিতে ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক আর সন্দেহ সর্বত্র। যেকোনো অসুখেই চিকিৎসাসেবা পাওয়াটা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বগুড়ার আদমদীঘি ও নওগাঁর রাণীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতালে কোনো চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে এক তরুণ। এমনকি তাকে নিজ গ্রামেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পটুয়াখালীতে দুজনের মৃত্যুর পর লকডাউন করা হয়েছে তিন গ্রামের পাঁচটি বাড়ি। মানিকগঞ্জে এক গৃহবধূর মৃত্যুর পর হোম কোয়ারেন্টিনে পুরো পরিবার।

করোনাভাইরাসে সংক্রমণ সন্দেহে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বিস্তারিত।

রাণীনগর (নওগাঁ) : নওগাঁর রাণীনগরে ঢাকা থেকে আসা আল আমিন (২২) নামের এক তরুণ তীব্র সর্দি, জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। পরিবারের দাবি, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে এই তরুণ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গত শনিবার রাতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। পরে রাতেই মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। গতকাল সকালে তাঁকে দাফন করা হয়।

আল আমিনের বাবা মকলেছুর রহমান বলেন, ‘ছেলেকে শনিবার নওগাঁ সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা চিকিৎসা না দিয়েই রাজশাহী নিয়ে যাওয়ার জন্য হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দেন। এরপর বিকেলে রাজশাহী মেডিক্যালে নিলে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই কিছু ওষুধ ও ইঞ্জেকশন লিখে দেন চিকিৎসকরা। তাতেও জ্বর কমছিল না। কোনো চিকিৎসকও আর ছেলের পাশে আসেননি। চিকিৎসা না পেয়ে আমার ছেলেটা মারা গেছে।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. কে এইচ এম ইফতেখারুল আলম বলেন, ‘শনিবার আল আমিনকে এখানে আনা হয়। তখন তার তীব্র জ্বর ও শ্বাসকষ্ট ছিল। অবস্থা বিবেচনা করে তাকে আমরা সদর হাসপাতাল পাঠিয়ে দিই। করোনায় আক্রান্ত সন্দেহেই আমরা তাকে চিকিৎসা দিতে পারিনি।’

রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, আল আমিন মেনিনজাইটিস রোগে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনা হলে এক দিনেই রোগী মারা যেত না। ওই রোগী ব্রেন ইনফেকশনে মারা গেছে। এ কারণে তার রক্তের কোনো নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি।’

পটুয়াখালী : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে সন্দেহে পটুয়াখালীতে তিনটি গ্রামে মোট পাঁচটি বাড়ি লকডাউন করেছে প্রশাসন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার কালিকাপুর এলাকার এক বাড়িতে গত শনিবার বিকেলে আব্দুর রশিদ (৬৫) নামের এক ব্যক্তি সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর বাড়িটি লকডাউন করে উপজেলা প্রশাসন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যু সন্দেহ করে আইইডিসিআর নির্দেশিত নিয়ম মেনে রাতেই জানাজা শেষে পটুয়াখালী সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়। আব্দুর রশিদ পেশায় ছিলেন একজন ভ্যানচালক।

এদিকে গতকাল সকালে বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে (শেবাচিম) আইসোলেশনে থাকা এক ব্যক্তি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। মারা যাওয়া জাকির হোসেনের (৪০) বাড়ি গলাচিপা উপজেলার যাদুয়া গ্রামে।

গলাচিপা থানার ওসি আক্তার মোর্শেদ জানান, জাকির বরিশালের মুলাদীতে গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি করতেন। তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। গত বুধবার তিনি বাড়ি আসেন এবং পরদিন সদর উপজেলার বহালগাছিয়ায় শ্বশুরবাড়িতে যান। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে শনিবার তাঁকে পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে শেবাচিমে নিয়ে করোনা ইউনিটের আইসোলেশনে রাখা হয়। গতকাল সকালে তিনি মারা যান।

শেবাচিমের পরিচালক ডা. জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি তিনি করোনায় আক্রান্ত। তাঁর নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।’

এদিকে জাকিরের শ্বশুরবাড়ি বহালগাছিয়া ও নিজ যাদুয়া গ্রামের বাড়িসহ পার্শ্ববর্তী আরো দুটি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ্ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জাকিরের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ হলে পুরো গ্রাম লকডাউন করা হবে। বর্তমানে ওই এলাকার মানুষকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

মানিকগঞ্জ : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ নিয়ে মানিকগঞ্জে সুচিত্রা সরকার (২৬) নামের এক গৃহবধূ মারা গেছেন। তিনি হরিরামপুর উপজেলার বলড়া ইউনিয়নের বড়ইছড়া গ্রামের নিতাই সরকারের স্ত্রী।

মুন্নু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক এস এম মনিরুজ্জামান জানান, সুচিত্রা চার দিন ধরে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তাঁর ডায়াবেটিস, হৃদেরাগ বা অন্য সমস্যা ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে যে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তিনি আরো জানান, ১১ দিন আগে সুুুচিত্রার শ্বশুর মারা যান। এ সময় বাড়িতে অনেক লোকের সমাগম হয়। সে সময় তিনি আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুল আমিন আখন্দ বলেন, মারা যাওয়া গৃহবধূর দেহের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ : জ্বর ও শ্বাসকষ্টে একজনের মৃত্যু ঘিরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে করোনাভাইরাস আতঙ্ক ছড়িয়েছে। উপজেলার খোনাপাড়া গ্রামের ইয়াসিন আলীর ছেলে গোলাম নবী (৫০) জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন বলে জানান স্বজন ও চিকিৎসকরা। গত শনিবার বিকেলে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান।

পরিবারের সদস্যরা জানায়, গোলাম নবী সাত দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরে শ্বাসকষ্ট আর অতিরিক্ত জ্বরে তিনি মারা যান। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা করোনায় মৃত্যু হয়েছে সন্দেহ করে ওই বাড়ি ও বাড়ির লোকজনকে এড়িয়ে চলছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, করোনায় নয়, গোলাম নবী লেফট ভেন্টিকুলার ডিজিজে ভুগছিলেন।

বরিশাল : শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নেওয়ার পথে এক নারীর (৪৫) মৃত্যু হয়েছে। গত শনিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে ওই নারীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। সেখান থেকে করোনা ইউনিটে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। রাতেই স্বজনরা তাঁর লাশ নিয়ে চলে যান।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন বলেন, ওই নারীর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ ছিল। কয়েক দিন আগে তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত এই হাসপাতালে ভর্তি হন। চার দিন চিকিৎসা শেষে গত বৃহস্পতিবার তিনি বাড়ি ফিরে যান। ওই নারীকে মৃত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই স্বজনরা লাশ নিয়ে যান। ফলে নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি।

খুলনা : খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে গতকাল সকালে সুলতান শেখ (৭০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। তিনি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পুরুলিয়া গ্রামের গফুর শেখের ছেলে। তিনি হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি ছিলেন। করোনা আইসোলেশন বিভাগের মুখপাত্র ড. শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, সুলতান শেখ যক্ষ্মায় আক্রান্ত ছিলেন। সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদও একই তথ্য জানান। চিকিৎসকরা জানান, সুলতান শেখের বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় আইইডিসিআরে কথা হয়েছে। বিবরণ জেনে সেখান থেকে জানানো হয়েছে যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না।

চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি : যশোরের চৌগাছায় করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ধারণা করে সাত বছরের এক শিশুর মরদেহ বিশেষ কায়দায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, শিশুটির মা-বাবা পোশাক কারখানার কর্মী। ঢাকার বাসায় কয়েক দিন ধরেই শিশুটি সর্দি-জ্বরে ভুগছিল। শনিবার দুপুরে মৃত্যুর পর অ্যাম্বুল্যান্সযোগে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে এনে রাতেই বিশেষ কায়দায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর পরপরই শিশুটির মা-বাবা ঢাকায় ফিরে যান।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/03/30/892393