৩০ মার্চ ২০২০, সোমবার, ১:০৮

সংশয় কাটছে না চিকিৎসা নিয়ে

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহ, উপসর্গসহ চিকিৎসা পেতে আগ্রহী মানুষের সংশয় কাটছে না। বরং প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়া, পরীক্ষা করাতে না পারার খবর আসছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই অভিযোগ উঠছে পরীক্ষা কম হওয়ার। বিশেষজ্ঞদের অনেকে পরীক্ষা আরো বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। গত দুদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে নতুন করে কারো মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত না হওয়ার বিষয়টিও এক শ্রেণির মানুষ সহজভাবে নেয়নি। অনেকের কাছে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

সরকারের পক্ষ থেকে দেশজুড়ে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কার্যকর রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এমনকি বেশির ভাগ হাসপাতালে রোগী আসছে না, এমন কথাও বলা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্র ও মাঠ পর্যায়ের মধ্যে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় না থাকার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা সন্দেহে যে কয়েকজনের মৃত্যুর তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাদের নমুনা পরীক্ষা করে ফলাফল প্রকাশের কথাও বলছেন তাঁরা। এ ছাড়া কারো মধ্যে করোনার উপসর্গ রয়েছে—এমনটা জানলে প্রতিবেশীসহ চিকিৎসকরা যাতে দূরে সরে না গিয়ে সহায়তার হাত বাড়ান সে জন্য আরো জনসচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারের মুখপাত্র রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত দেশে মোট এক হাজার ১৮৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৪৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। ১৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে, বাকি ২৮ জন হাসপাতালে আছে। আর আইসোলেশনে আছে ৫৬ জন। আইসোলেশনে যারা থাকে তাদের সবার নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

এদিকে বগুড়ায় জ্বর, সর্দি-কাশির উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশীদের সহায়তা না পেয়ে ঘরেই একজনের মৃত্যুর ঘটনা গতকাল দিনভর ব্যাপক আলোচনায় ছিল। সেই সঙ্গে বরিশালে আইসোলেশনে থাকা দুজনের মৃত্যু করোনাভাইরাসে হয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ দূর করতে আইইডিসিআরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অনেকে। আর মানিকগঞ্জে আরেকজনের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের কথা প্রচার পেয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

বিষয়টি নজরে আসায় বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্যসচিব (সেবা) মো. আসাদুল ইসলামের উপস্থিতিতে জরুরি বৈঠক করা হয়। বৈঠকে হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরিয়ে দেওয়া, ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ থাকা, কেউ অসুস্থ হলেই করোনা ভয়ে দূরে সরে যাওয়ার মতো প্রবণতা বন্ধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়। এর ভিত্তিতে স্থানীয়ভাবে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় আরো শৃঙ্খলা

ফিরিয়ে আনা, রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসক নেতাদের সমন্বয়, কেন্দ্রীয়ভাবে চিকিৎসক সংগঠনের নেতাদের মাধ্যমে সারা দেশে চিকিৎসকদের আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করার ওপরও জোর দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সারা দেশে চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তা উপকরণ ঠিকভাবে পৌঁছেছে কি না সে বিষয়েও আলোচনা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে সেগুলো সমাধানে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। যেখানে যাদের সহায়তা প্রয়োজন আমরা তাদের সম্পৃক্ত করে সমস্যা কাটিয়ে সারা দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাকে উপযুক্ত মাত্রায় সচল ও স্বাভাবিক রাখতে প্রক্রিয়া চালাচ্ছি। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বাকি সমস্যা কেটে যাবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বেনজির আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথম দিকে একমাত্র আইইডিসিআরে পরীক্ষার সুযোগ রাখায় অনেকে বারবার ফোন করে কিংবা যোগাযোগ করেও পরীক্ষা করাতে পারেনি। ফলে সবার মধ্যে পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে সরকারের পদক্ষেপে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। অনেকের ধারণা হয়েছে, আইইডিসিআর হয়তো বিষয়টি সংকুচিত করে রাখতে চায়। ফলে এখন পরীক্ষার জন্য আরো কয়েকটি সেন্টার চালু হলেও মানুষের মধ্যে একই ধরনের পরীক্ষাবিমুখ মনোভাব রয়ে গেছে, যে কারণে হয়তো নতুন সেন্টারগুলোতে লোক কম আসছে। নতুন সেন্টারগুলোর ব্যাপারে প্রচার চালালে পরীক্ষার প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়বে। এ ছাড়া কেন্দ্র আর মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের ঘাটতি থাকায় মানুষের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। এই ঘাটতি দূর করতে হবে।’

রোগতত্ত্ববিদ ও আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে থেকেই নির্দেশনা দেওয়া আছে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে যাঁরা হাসপাতালে আসবেন তাঁদের সেবা দিতে হবে। প্রয়োজনে আইসোলেশনে রেখে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করবে সংশ্লিষ্ট স্তরের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে যাঁরা মারা যান, তাদের নমুনা সংরক্ষণ করতেই হবে। আবার মারা যাওয়ার পরও নমুনা নেওয়ার জন্য বলা আছে। ইতিমধ্যে একাধিক মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠার পর তাঁদের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ পাওয়া গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে মারা গেলেই যে করোনায় মৃত্যু হয়েছে, সেটা বলে মানুষকে শঙ্কিত করা ঠিক না। সবারই ধৈর্য ধরা উচিত পরীক্ষার ফলাফলের জন্য।’

এদিকে গত দুই দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ রোগীরা বিভিন্ন হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা না পাওয়ার খবর আসছে কালের কণ্ঠ’র প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। খুলনায় গত শনিবার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সব রোগীর চিকিৎসা বন্ধ থাকায় সাধারণ রোগীরা সেখান থেকে ফিরে যায়, যা নিয়ে স্থানীয় চিকিৎসকদের মধ্যেও ছিল অসন্তোষ। গতকাল বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনা শাখার মহাসচিব ডা. মেহেদী নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক দিন কিছুটা সমস্যা ছিল, তবে সেটি কেটে গেছে। এখন শুধু খুলনা বারডেমকে করোনাভাইরাসের ব্যবস্থাপনার জন্য সাজানো হচ্ছে। ফলে খুলনা মেডিক্যাল কলেজে অন্য সব চিকিৎসা আগের মতোই চলবে।’

তবে অনেক হাসপাতাল রোগীর অভাবে খালি পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। ঢাকার শেরেবাংলানগরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুরো হাসপাতালে মাত্র কয়েকজন রোগী আছে। বাকি সব খালি। বেশির ভাগ ওয়ার্ডই রোগীশূন্য। এ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘সব কিছু বন্ধ থাকার প্রভাবে হাসপাতালে রোগী কমে গেছে। অন্য সময়ের তুলনায় হাসপাতাল প্রায় শূন্য। তবে আমরা সব চিকিৎসক ও কর্মচারী নিয়মিত হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রেখেছি করোনাভাইরাসসংক্রান্ত চিকিৎসারও। এ পর্যন্ত এই হাসপাতালে মাত্র দুজন সন্দেহজনক রোগী এসেছেন। তাঁদের কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, সড়ক যোগাযোগসহ সব কিছু বন্ধ থাকার কারণে সারা দেশেই বেশির ভাগ হাসপাতালে রোগী আসতে পারছে না। তবে জরুরি যাদের প্রয়োজন তারা ঠিকই আসছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/03/30/892388