৩০ মার্চ ২০২০, সোমবার, ১২:৫৮

কোভিড-১৯ : পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনধারা

সাত সকালে উঠে গাড়ি ধরে কর্মস্থলে হাজির হওয়ার তাড়া নেই। ডানে বায়ে না তাকিয়ে ভীষণ ব্যস্ত জীবনের ঘানি টানারও তাগিদ নেই। সব কিছুই যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। বদলে গেছে যাপিত জীবনের ধরণ। দ্রুতই বদলে যাচ্ছে পরিচিত চার পাশ ও আমাদের জীবনযাপনের ধারা। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের দিন কাটে এখন অনেকটাই একই রকম। ভাবনা অনুভূতিতেও আশ্চর্যজনক মিল। অদৃশ্য এক অণুজীবের হানা মুহূর্তে বদলে দিয়েছে সব কিছুকে। সবাই এখন এক ভাবনায় মশগুল। কবে থেকে এর থেকে মুক্তি মিলবে? মানুষ গেয়ে উঠবে মুক্তির জয়গান।

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ে বিশ্বের সব গণমাধ্যম এখন একযোগে সক্রিয়। রয়টার্স, সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরা, এএফপির মত সব বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা ও গণমাধ্যমের এ মুহূর্তের আপডেট একটাই। কোন দেশে কত আক্রান্ত, মৃত্যুর হার কত প্রভৃতি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় এর আপডেট দিচ্ছে এসব সংস্থা। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের খবরের প্রধান উৎস হিসেবে এসবের ব্যবহারের পাশাপাশি গুগল থেকেও আপডেট জানা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আপডেটগুলোও পরিমিত। তারা অফিসিয়াল ভাষ্য এবং প্রকৃত চিত্র জেনেই তা প্রচার করছে। বিশ্বগণমাধ্যগুলো নিজস্ব তথ্যসূত্র ব্যবহার যেমন করছে ঠিক তেমনি বিরল এক অভিজ্ঞতার মহামারী আক্রান্ত বিশ্বের খুঁটিনাটি বিষয়ও তারা প্রচার করছে। লক্ষণীয় বিষয়Ñ কোনো তথ্যই স্থায়ী হচ্ছে না। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির কারণে তা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তন হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের ওষুধ আবিষ্কার নিয়ে আগ্রহ দুনিয়াজোড়া। হাজার হাজার বিজ্ঞানী এর পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। কিন্তু নিশ্চিত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কারের খবর এখনো আসেনি। বৈশ্বিক অর্থনীতির যে ভয়াবহ মন্দা ধেয়ে আসছে তা নিয়ে চিন্তিত অনেকেই। বলতে গেলে প্রযুক্তি বিশ্বকে একটি সুতোয় গেঁথে ফেলার যে ধারণা দুই দশক ধরে উচ্চারিত হচ্ছিল, তা এখন থমকে আছে। দেশগুলোর আকাশ, স্থল ও সাগরপথের যোগাযোগ এখন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। আসন্ন মন্দা থেকে বাঁচতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীনের মতো দেশগুলো এই মহাদুর্যোগে যে প্রণোদনা দিচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সে রকম সামর্থ্য নেই। তারা এখন তাই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে। সঙ্কট আরো দীর্ঘ হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোই সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাদের দুর্দশাগ্রস্ত স্বাস্থ্যখাত আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। করোনা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোর যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে, তা ভয়াবহ। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কোনো সুরক্ষিত ব্যবস্থাই সেখানে নেই। চীনে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি। ১০ জানুয়ারি সেখানে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। চীন অতিদ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহানকে বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ১০ দিনে একটি হাসপাতাল তৈরি করে। ৮১ হাজার ৪৩৯ আক্রান্তের মধ্যে সেখানে মারা গেছেন তিন হাজার ৩০০ জন। গতকাল পর্যন্ত সেখানে অসুস্থ রোগীর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৬৯১। নতুন মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচজন। এর বাইরে ইতালি, ফ্রান্স, আমেরিকা, স্পেন, ইরান ও ব্রিটেনে আক্রান্তের হার বেশি। ইতালিতে ৯২ হাজার ৪৭২ আক্রান্তের মধ্যে মারা গেছেন ১০ হাজার ২৩ জন। ইতালিতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার গতকাল আর বৃদ্ধি পায়নি বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো জানিয়েছে। তবে আমেরিকায় পরিস্থিতি এ মুহূর্তে খুবই উদ্বেগজনক। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা ঘোষণার মধ্যেই সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৩ হাজার ৭৮১ জনে। স্পেনে করোনা ছড়িয়েছে গতকালও। ৭৮ হাজার ৭৯৭ আক্রান্তের সাথে নতুন যোগ হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৬২ জন। মৃতের সংখ্যা ছয় হাজার ৫২৮ ছাড়িয়ে গেছে। এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বিশ্বের ১৭৭টি দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ হাজার ৮৫ জনে পৌঁছেছে। আধুনিককালে একটি রোগে এত অধিকসংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্ববাসী আর দেখেনি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, করোনা আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দেবে। আর সে পরিবর্তন হবে বিশ্ব রাজনীতির প্রথাগত ধ্যান-ধারণার বিরোধী। মানুষের জীবনাচার, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক জীবন সবখানেই সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনবে। যেমন এনেছে জীবনযাপনে হঠাৎ পরিবর্তনে। তাদের মানসিকতায়ও হয়তো আসবে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/492109/