২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ১২:৫৯

প্রস্তুতি পদক্ষেপে হঠাৎ তোড়জোড়

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের সংকটের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পর কয়েক দিন ধরে অনেকটা হঠাৎ করেই বেড়েছে তত্পরতা। নেওয়া হয়েছে নতুন কিছু পদক্ষেপ। বিশেষ করে, গত রবিবার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশে ১০ দফা একটি কর্মপন্থা ও নির্দেশনা তৈরির পর থেকেই আগের তুলনায় নড়েচড়ে বসেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা।

সেই সঙ্গে ২৫ মার্চে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আরো বিশেষ কিছু নির্দেশনার পর গতি বেড়ে যায় দ্রুত। ফলে গত তিন দিনে দেশের অন্তত সব জেলা ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই পৌঁছে যায় চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য বিভিন্ন সংখ্যায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ। সেই সঙ্গে পরীক্ষার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সঙ্গে ঢাকার মহাখালীতে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজে শুরু হয় পরীক্ষা। ফলে দেশে পরীক্ষার সংখ্যা আগের দিনগুলোর তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বাইরে আরো কয়েকটি এলাকায় পরীক্ষার যন্ত্রপাতি স্থাপন ও চালুর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন ভবনে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের ব্যস্ততাও আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। বিভিন্ন দলে ভাগ করে প্রতিদিন সকাল থেকে সারা রাত পর্যন্ত চলে কার্যক্রম। সারা দেশ থেকে কোনো দল তথ্য সংগ্রহ করছে, কেউ বা চাহিদা তালিকাভুক্ত করছে, কেউ বিভিন্ন জায়গায় উপকরণ পাঠানোর কাজ করছে, কেউ বা সরকারের নির্দেশনা ও পরিকল্পনা কার্যকর করতে নির্দেশনা দিতে ব্যস্ত থাকছে। আবার কেউ গণমাধ্যমে তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুরু থেকেই আমাদের একের পর এক কার্যক্রম চলছিল। প্রধানমন্ত্রী প্রথম থেকেই আমাদের সব ধরনের নির্দেশনা দিয়ে আসছিলেন। তার পরও এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী যে ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটা ধরে কাজের গতি আরো বেড়ে গেছে। এখন আমাদের কোনো রাত-দিন নেই। বন্ধ নেই। ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে ও চলবে।’

মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘শুধু নিরাপত্তা উপকরণ বা পরীক্ষাই নয়, এর বাইরে প্রতিদিনই আরো বহু রকম কাজ করতে হচ্ছে আমাদের। এর মধ্যে করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে বেশ কিছু গাইডলাইনও তৈরি করতে হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যদের সহায়তা নিয়ে। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরাও এ ক্ষেত্রে কাজ করছেন।’

কভিড-১৯ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় চালু করা কন্ট্রোল রুম সূত্র থেকে জানা গেছে, এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত রোগীর হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর (পিপিই) যুক্তিসংগত ব্যবহার, করোনা জীবাণুমুক্তকরণ এবং পরিবেশগত সংক্রমণ রোধ সংক্রান্ত নির্দেশনা, বাড়িতে পরিচর্যার নির্দেশনা বা করোনায় আক্রান্ত সন্দেহজনক রোগী, যার মৃদু সংক্রমণ রয়েছে এবং করোনায় আক্রান্ত রোগী, যার হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই তাদের জন্য গাইডলাইন করা হয়েছে, যা গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে কখনো বিজ্ঞাপন আকারে আবার কখনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। এ ছাড়া ওয়েবসাইটে তো আছেই।

অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ প্রতিরোধে গর্ভবতী মা ও পরিবারের করণীয়, কুসংস্কার দূরীকরণ, বয়স্ক ও শিশুদের মানসিক চাপমুক্ত থাকার আলাদা কৌশলপত্র, করোনা রোগে মৃত ব্যক্তির মৃতদেহ নিরাপদভাবে সত্কার ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা সন্দেহে থাকা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন, হাসপাতাল ও বিমানবন্দরে কভিড-১৯ রোগীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে।

পাশাপাশি করোনা মোকাবেলায় জীবাণুনাশক দ্রবণ তৈরির নিয়ম, করোনা কেস ডেফিনেশন, সামাজিক কুসংস্কার বা সোশ্যাল স্টিগমা, রোগী শনাক্তকরণের পরীক্ষায় অনুসরণীয় বিষয়গুলো, হাসপাতালে করোনাসংক্রান্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নির্দেশনাও তৈরি করা হয়েছে।

অন্যদিকে কন্ট্রোল রুমের অন্যতম সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত সারা দেশে মোট তিন লাখ তিন হাজার পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নানা ধরনের উপকরণ সাহায্য আসছে।

কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে সারা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের জন্য ৩২৩টি প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে একবারে ১৮ হাজার ৯২৩ জনকে তাত্ক্ষণিক সেবা দেওয়া যাবে। এসব প্রতিষ্ঠানে সেবা দেওয়ার জন্য এক হাজার ১২৩ জন চিকিৎসক, এক হাজার ৫৭৫ জন নার্স এবং অন্য এক হাজার ২৮৪ জনসহ মোট তিন হাজার ৯৮২ জন সেবাদানকারী প্রস্তুত রয়েছেন।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সফি আহম্মদ মুয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুসারে আমাদের এখানে পরীক্ষা শুরু করেছি। তবে এটা অন্য হাসপাতালের মাধ্যমে আমাদের কাছে নমুনা পাঠাতে হবে। কোনো রোগী যেন আমাদের এখানে সরাসরি না আসেন। এ ছাড়া আমাদের এখানে চিকিৎসাকর্মীদের উপকরণও পাওয়া গেছে।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়াও বলেন, ‘এখন পিপিইর সংকট কেটে গেছে। আমাদের পিপিই দেওয়া হয়েছে।’

ঢাকার বাইরেও পৌঁছে গেছে পিপিই। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বাকির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ইতিমধ্যে এক হাজার পিপিই পেয়েছি। এ ছাড়া পরীক্ষার যন্ত্রও আসবে বলে জানানো হয়েছে।’

এ ছাড়া করোনা রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনে ব্যবহারের লক্ষ্যে এরই মধ্যে সরকার এক লাখ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইন ওষুধ হাতে রেখেছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এরই মধ্যে এ ওষুধ সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া যেসব দেশীয় কম্পানি এই ওষুধ তৈরি করছে, তাদের তা আরো উৎপাদন করাসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে এ ওষুধ তৈরির আহ্বান জানিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার চীন থেকে ১০ হাজার টেস্ট কিট, ১০ হাজার ‘পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই)’ এবং এক হাজার ‘ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের’ একটি চালান বিশেষ ফ্লাইটযোগে ঢাকায় পৌঁছে। গতকাল শুক্রবার চীন থেকে আরো ৩০ হাজার টেস্ট কিট ঢাকায় পৌঁছেছে। এ ছাড়া ভারতের সহায়তাসামগ্রীর মধ্যে ছিল ৩০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক এবং ১৫ হাজার ‘হেড কাভার’। পাশাপাশি দেশের বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বেশ কিছু উপকরণ দিয়েছে এরই মধ্যে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/03/28/891536