২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ১২:২৬

পেটের টানে মরণের ভয়ও তাদের কাছে তুচ্ছ

সেলিম চিৎকার করে বলছিলেন আমার বাচ্চারা কী খাবে?

মানিকনগর কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা সাহেরাকে কম-বেশি সবাই চেনেন। বিশেষ করে যারা ওই বাজার থেকে কেনাকাটা করেন। কাঁচাবাজারের মধ্যে ডাস্টবিনের পাশেই তার সবজির দোকান। একটু কম দামি সবজি বিক্রি করেন বলে তাদের দোকানে সার্বক্ষণিক ভিড় লেগেই থাকে। এই মহা দুর্যোগের মধ্যেও সাহেরার দোকানটি বন্ধ হয়নি। পুরো কাঁচাবাজারে যে ক’টি দোকান বন্ধ হয়নি তার মধ্যে ওটি একটি। সাহেরা জানালেন, বন্ধ হওয়ার কোনোই আশঙ্কা নেই। সরকার তো সবজির দোকান বলে একটু সুযোগ দিয়েছেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পেটের খাবার জোগাড় করতে তাকে দোকানটি খোলা রাখতেই হবে!

সাহেরা জানালেন, মৃত্যুর ভয় তো সবারই আছে। তারও আছে। লেখাপড়া না জানলে কী হবে, মানুষের কথা তো বুঝতে পারেন! বাইরে থাকায় ভাইরাসটি তাকেও আক্রমণ করতে পারে, তার পরিবারের সদস্যদের আক্রমণ করতে পারেÑ এই বুঝ আছে তার। কিন্তু পেট তো মানে না। তিনি জানালেন, আপতত তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তা পেলে আজ থেকে তিনি আর দোকান নিয়ে বসবেন না।

শুধু সাহেরাই নন, মানিকনগর বাজারে যারাই দোকান খুলে বসেছেন তাদের অনেকেরই একই বক্তব্য। মাছ বিক্রেতা সিদ্দিক জানালেন, বাজারে যারা দোকান নিয়ে বসেছেন তাদের কারো ঘরেই খাবার নেই। যাদের ঘরে দু’চার দিনের খাবারের সংস্থান আছে, তারা কেউ দোকান নিয়ে বসেননি। তিনি নাম ধরে ধরে বললেন, কারা কারা দোকান নিয়ে বসেননি। তাদের প্রত্যেকেরই ঘরে দু’চার দিনের খাবারের টাকা জমা আছে। এক দিন দোকান না করলে তাদের পুঁজি ভেঙে খেতে হবে না।

শুধু রাজধানীতেই নয়; গোটা দেশেই প্রান্তিক মানুষগুলোর এই অবস্থা। জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে কেউ এখন আর বাইরে বের হতে চান না। নিতান্তই বাধ্য না হলে সবাই ঘরে থাকতে চান। রাজধানীর টিকাটুলি এলাকায় কথা হয় রিকশাচালক মাহবুবের সাথে। মুখে মাস্ক আর হ্যান্ড গ্লাভস পড়ে রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন। মাহবুব জানালেন, ঘরে কোনো খাবার নেই। তাদের তো জমানো টাকা নেই। দিনে যা পান তাই দিয়ে রিকশার জমা দেন, বাকি টাকা সংসারের খরচা। আর দু-এক দিনের জন্য যদি হতো তাহলে চুপচাপ ঘরে বসে থাকতেন। কত দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তার নিশ্চয়তা নেই। বাধ্য হয়েই রাস্তায় নেমেছেন বলে জানালেন মাহবুব। তার বক্তব্যÑ কারো কাছে গিয়ে যে হাত পাতবেন সেই সুযোগও তো নেই। তিনি বলেন, পেটের টানে মরণ আর পুলিশের লাঠির বাড়ি কোনো কিছুতেই ভয় নেই।

পরিবহন শ্রমিক নেতা আলী রেজা নয়া দিগন্তকে বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের জমানো কোনো টাকা নেই, যা দিয়ে তারা এক দিন চলবেন। তাদের প্রায় সবাই দিন আনেন দিন খান। এরা দু’দিন হয়তো চলেছেন কোনোভাবে। আর চলতে পারবেন না। না খেয়ে থাকতে হবে। মালিক এবং সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সহায়তা করা হয়নি। আলী রেজা বলেন, বেশির ভাগ মালিক এখন মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন, যাতে শ্রমিকরা তাদের কাছে টাকা চাইতে না পারে।

গতকাল রাত ৮টার দিকে কেরানীগঞ্জে বাবুবাজার ব্রিজের ঢালে সেলিম নামের এক রিকশাচালককে বেধড়ক পেটায় পুলিশ। এ সময় সেলিম চিৎকার করে বলছিলেন, আমার বাচ্চারা কী খাবে? আমার ঘরে কোনো খাবার নেই। সেলিম কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা এলাকায় জসিম উদ্দিনের বাড়িতে থাকে। সেলিম জানান, ঘরে ছেলেমেয়েরা খাবারের জন্য কাঁদছে। দু’দিন ধরে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামেননি। বাচ্চাদের আর কান্না সহ্য করতে না পেরে মরণের ভয় না করে রাস্তায় নেমেছেন। গত রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশকে রিকশাচালকদের লাঠিপেটা করতে দেখা যায়।

মানবাধিকার নেটওয়ার্ক ম্যাপসি বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল বলেন, আমরা চরম ঝুঁকির মধ্যে আছি। অনেক মানুষ আছে যাদের কোনো ঘর নেই। তারা কোথায় যাবে? কম-বেশি প্রায় সাত কোটি শ্রমিক আছে। তারা সবাই এখন কর্মহীন। তাদের কী অবস্থা হবে। এখনই এসব ভাবতে হবে। সরকারের উচিত এখন থেকে স্পেশাল রেশনিং-ব্যবস্থা চালু করা। সে ক্ষেত্রে ধনিক শ্রেণীর লোকদের এগিয়ে আসা উচিত। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকার মতো বিশ্ব যখন হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের সরকার কিইবা করবে? আমাদের সবারই উচিত নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সরকারকে সহায়তা করা। মানবাধিকার কর্মী মোস্তফা সোহেল বলেন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের মানবিক হতে হবে। এই দুর্যোগের সময় তাদের কাছ থেকে আমরা মানবিকতা চাই।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/491590/