রাজধানীর ডাস্টবিনগুলোতে পথশিশুদের কোয়ারেন্টাইন নেই। ক্ষুধা মানে না ভয়াবহতা। এদের দায়িত্ব কে নেবে?-সংগ্রাম
২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ১২:১১

করোনা ঝুঁকিতে ঢাকার লাখ লাখ বস্তিবাসী

# রাজধানীর প্রধান সড়কে জীবাণুনাশক ছিটালো ডিএনসিসি
# মোহাম্মদপুরের ৫৪টি ভবন পুলিশের নজরদারিতে
ইবরাহীম খলিল : কাঠ, বাঁশ আর টিনের ছোট ছোট খুপরি। গায়ে গা লাগানো খুপরির সারি। মাঝখানে আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা। রাস্তার ওপরেই মাটির জ্বলন্ত চুলা। অলিগলি জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো ময়লা। দুর্গন্ধময় টয়লেট। খোলা গোসলখানার টিউবওয়েলের পাশেই আবর্জনার স্তূপ-এমনই দৃশ্যপট নগরীর প্রতিটি বস্তির। বস্তিগুলোর একেকটি খুপরিতে গাদাগাদি করে বসবাস করেন নিম্ন আয়ের মানুষ। এসব বস্তিতে বসবাসকারী ঢাকা শহরের রয়েছে লাখ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে সংক্রমণ হলে মহামারি লাগার ভয় বিশেষজ্ঞদের।

রাজধানীতে বসবাসকারী বাসিন্দাদের নারী সদস্যরা বেশিরভাগ বাসাবড়ীতে গৃহকর্মীর কাজ করে থাকেন। বাড়ির পরিচ্ছন্নতার কাজটিও করেন তারা। বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যে সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হলেও জীবাণুমুক্ত থাকতে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার কথা বলা হলেও তা কতটুকু সম্ভব হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইসিডিআর বলছে, দেশে ইতিমধ্যে সীমিত আকারে করোনাভাইরাসের সামাজিক বা গণসংক্রমণ শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঘনবসতির এই বস্তিগুলো একদমই অরক্ষিত।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশনা মানতে পারছে না দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো। তাদের মধ্যে একজন আক্রান্ত হলে মহামারি অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার ভয় রয়েছে। তবে বস্তিবাসীর মধ্যে অনেকের বিশ্বাস, করোনায় আক্রান্ত তো দূরের কথা কিছুই হবে না তাদের। সারাদিন কাজ করতে গিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্যেই থাকেন তারা।

রাজধানীর মিরপুরের ভাসানটেক বস্তির মানুষগুলো করোনার নাম না জানলেও একটা ভাইরাস এসেছে দেশে এ বিষয়ে জানে অনেকেই। কিন্তু এই বিপদ ঠেকাতে করণীয় সম্পর্কে জানা নেই তাদের। মাজেদা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘শুনছি একটা ভাইরাস আইছে। নাম নাকি করন্না। তয় পয়পরিষ্কার থাকলে নাকি ওই রোগ অয় না। আমাগো আর চিন্তা কী! আমরা তো পয়পরিষ্কারই থাকি।’

মিজান নামের একজন বলেন, ‘কয়দিন হইলো মাথাব্যথা। আমার কি করন্না হইছে?’ এ নিয়ে চিন্তিত তিনি। বিভিন্ন বাসায় যারা কাজ করেন, গৃহকর্ত্রীর ঘন ঘন হাত ধোয়ার ঘটনায় অবাক বনে যান অনেকে। তাদেরও বারবার হাত ধোয়ার তাগাদা দেন গৃহকর্ত্রী। এতে বিরক্ত হন অনেকে। তাদের ভাষ্য হলো-- গৃহকর্মীকে হাত ধোয়ার কথাও বললেও আর কোনো সচেতনতামূলক নির্দেশনা দেন না গৃহকর্ত্রীরা। গৃহকর্মী জুলেখা আক্তার বলেন, ‘আফায় খালি হাত ধুইতে কয়। কেন কয় জানি না। একটা ডিব্বায় টিপ দিলে সাবান বাইর হয়, এইটা দিয়া হাত ধুই। আর কাপড়চোপড় ভালো কইরা ধুইয়া পরতে কয়।’ গৃহকর্মী রিনা বলেন, ‘ভাইরাস আইছে। মালিকরা সাবধানে থাকতে কয়।’

করোনাভাইরাসে বৃদ্ধদের ঝুঁকি বেশি এমন কথাই শুনছেন সত্তোরের বেশি বয়সী জেবুন্নেসা। তিনি বলেন, ‘বয়স্ক গো নাকি এই রোগে বেশি ধরে। খালি হাত ধুইতে আর পরিষ্কার থাকতে কয়।’ কাজের খুঁজে নগরীতে আসা এই মানুষগুলো কাজ পেলেও অভ্যাসের পরিবর্তন হয় না তাদের। ঘনবসতি হলেও সবাই সবার ঘর ও আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখলে যেকোনো রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বস্তিতে যারা থাকেন, এই করোনার সময় খুবই পরিষ্কার রাখতে হবে। ময়লাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে না রেখে এক জায়গায় ফেলতে হবে। নখ কেটে রাখতে হবে সব সময়। আগে গরম পানি দিয়ে বাসন ধুয়ে নিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে সাবান দিয়ে কাপড়-চোপড় ভালোভাবে পরিষ্কার করতে। কষ্টকর হলেও পরিষ্কার থাকার অভ্যাসটা তৈরি করতে হবে।' তবে করোনায় যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার কথা বলা হচ্ছে সেটা ঘনবসতির মানুষগুলো মেনে চলবে কীভাবে। সুরত আলী নামের একজন বললেন, ‘আমরা দূরে দূরে থাকুম কেমনে! ছোট্ট খুপরিতে সবাই একসঙ্গে থাকি। আর অখন তো বস্তির বাইরেও যাওন যায় না।’ এই ভাইরাস একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে যায়- এমনটা শুনেছেন তিনি। সুরত আলী লোকমুখে করোনাভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ-উপসর্গের হিসেবে সর্দি-কাশির কথা শুনেছেন। কিন্তু তার কথা হলো--বস্তিতে তো সব সময় সর্দি-কাশি লেগে থাকে। কেমনে বুঝব কোনটা করোনা। দেশজুড়ে যদি গণসংক্রমণ হয় তাহলে ঘনবসতির এই অরক্ষিত বস্তির মানুষরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্নবিত্তের মানুষ, বিশেষ করে বস্তির মানুষেরা। একে তো খাবার সংকটে থাকবে, পাশাপাশি সচেতনতার অভাবের তারা বুঝতেই পারবে না যে তাদের কোভিড-১৯ হয়েছে কি-না। আর লক্ষণ বুঝে তারা কখনোই আইইডিসিআরকে কল করবে না।’ সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন এবং লোকাল গভর্মেন্টের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে বলে মত দেন ড. মঈনুল।

বস্তির অনেকের হাতেই রয়েছে স্মার্টফোন। করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা শুনতে পেলেও সাধ ও সাধ্যের পার্থক্য তাতে বড় বাধা। হাত ধোয়ার জন্য নেই পর্যাপ্ত পানি। নেই সাবান কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এ ছাড়া পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি জীবিকার সন্ধানে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় বলে। মেয়ের মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে সুফিয়া বানু বলেন, ‘এত কিছু করোম কহন? সব আল্লায় ঠিক কইরা দিব।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা তাজিনা সারোয়ার বলেন, করোনার সময়গুলোতে বস্তিগুলো পরিচ্ছন্ন রাখা ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সচেতনতার জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর সেগুলো সমন্বয় করবেন।

প্রতি ওয়ার্ডে বিশেষ করে বস্তি এলাকায় ১০টি করে বেসিন স্থাপনের জন্য নির্দেশনা পেয়েছেন বলে জানান উত্তর সিটির বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় তো ওষুধ ছিটিয়ে ধোয়া হচ্ছে। কিন্তু বস্তির ভেতরে আমাদের গাড়ি যেতে পারে না। তবে সেগুলোতেও স্যানিটাইজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইড মিরপুর ও কড়াইলের প্রায় ২৭টি জায়গায় বেসিন বসিয়েছে। সচেতনতার জন্য তারা ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছে।' ভাসানটেকের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সালেক মোল্লা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ওরা গরিব মানুষ। আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে সচেতন করতে এবং তাদের এলাকাটা পরিষ্কার রাখতে।

এদিকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এবং একত্রে দুজনের চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও তা অনেক এলাকার মানুষ মানছেন না। এজন্য অনেকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন। এরপরও এক রিকশায় দুই থেকে তিনজন করে চলাচল, একত্রে তিন থেকে চারজনের দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর চিত্র দেখা গেছে রাজধানীতে। শুক্রবার দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা এমন চিত্র দেখা গেছে। সড়কে মানুষ অবাধে ঘোরাফেরা করে। শিশু থেকে শুরু করে যুবক এমনকি বয়োবৃদ্ধদেরও মাস্ক ছাড়া সড়কে চলাচল করতে দেখা গেছে।

এদিকে গতকাল শুক্রবার ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকার প্রধান প্রধান সড়ক ও উন্মুক্ত স্থানে ৮টি পানির গাড়িতে মোট ১৬ বার ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত জীবাণুনাশক তরল ছিটানো হয়েছে। এদিন উত্তরা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, আশকোনা, উত্তরা সেক্টর-৪ ও সংলগ্ন এলাকা, যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে থেকে কোকাকোলা বাসস্ট্যান্ড, নিকুঞ্জ এলাকা, মিরপুর সেকশন ১ মুক্তবাংলা মার্কেটের পিছনে ও সংলগ্ন এলাকা মিরপুর-১ সরকারি কোয়ার্টারের ভিতরে ও সংলগ্ন এলাকা গাবতলী হতে কল্যাণপুর, মিরপুর ৬০ ফুট রোড ও সংলগ্ন এলাকা মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড, কলেজগেইট, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও সংলগ্ন এলাকা মগবাজার, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, আইসিডিডিআরবি মহাখালী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা ফার্মগেইট ও সংলগ্ন এলাকায় জীবাণুনাশক তরল ছিটানো হয়।

জানা গেছে, ৮টি পানির গাড়ির মাধ্যমে মোট ১ লক্ষ ৬০ হাজার লিটার তরল জীবাণুনাশক ডিএনসিসির ২৪ লক্ষ বর্গফুট এলাকায় ছিটানো হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডের অলিগলিতে মশক নিধনকর্মীগণ হ্যান্ড স্প্রে ও হুইলব্যারো মেশিনের তরল জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়েছে।

এদিকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও মশককর্মীদের জন্য ১২০০ জোড়া উন্নত মানের গ্লাভস ও ১০০০ জোড়া বুট-জুতা বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে ৫০ কেজি ব্লিচিং পাউডার ও ২০০টি সাবান বিতরণ করা হয়। সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের প্রত্যেককে ২৫ কেজি ব্লিচিং পাউডার ও ২০০টি সাবান বিতরণ করেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিংসহ ওই এলাকার ৫৪টি ভবন পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে বাড়িগুলো পুলিশের নজরদারি থাকবে বলে জানা গেছে। শুক্রবার ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ওই ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে। মোহাম্মদপুর থানার ওসি আবদুল লতিফ বলেন, আইইডিসিআরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই এলাকায় করোনায় আক্রান্ত রোগী থাকতে পারে কিংবা আছে পুরো মোহাম্মদপুর এলাকার এরকম ৫৪টি বাসার তালিকা আমরা পেয়েছি। আইইডিসিআর থেকে পুলিশ সদর দপ্তর মাধ্যমে পাওয়া ওই তালিকা অনুযায়ী ৫৪টি বাসাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

http://dailysangram.info/post/411487