রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা শাপলা চত্বর যেন থমকে আছে। ছবিটি গতকাল শুক্রবার তোল -সংগ্রাম
২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ১২:০২

জনশূন্য রাজধানীতে চুরি ডাকাতির আতঙ্ক বাড়ছে

পুলিশের দাবি করোনার কারণে অপরাধ কমেছে
­নাছির উদ্দিন শোয়েব: বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ঠেকাতে রাজধানীবাসী ঘরে অবরুদ্ধ। নগরী এখন অনেকটাই ফাঁকা। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকায় নগরী জুড়েই সুনশান নীরবতা। জরুরি সার্ভিস ছাড়া, সব মার্কেট ও দোকানপাট বন্ধ। রাস্তায় নেই কোন যানবাহন। সেনা ও র‌্যাব-পুলিশের টহলেও মানুষের মাঝে অজানা আতঙ্কে নগরবাসী। তবে ঘরে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে চুরি-ডাকাতি না করতে পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। অন্যদিকে পুলিশ বলছে-করোনার কারণে গত একমাসে সব ধরনের অপরাধ কমেছে।

সরজমিনে দেখা গেছে, নগরীর কোথাও তেমন জনসমাগম নেই। কেউ বেরুচ্ছে না ঘর থেকে। জরুরি প্রয়োজনে যারা ঘরের বাইরে আসছেন, তাদেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কড়াকড়ির আওতামুক্ত কেবলই জরুরি সার্ভিস। বিশেষ প্রয়োজনে বের হওয়া সীমিত সংখ্যক যানবাহনকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছাড়াও রয়েছে সেনাবাহিনীর টহল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে, মাঠে তৎপর সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তবে এমন পরিস্থিতিতে চরম বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ।

বুধবার থেকে রাজধানীসহ সারাদেশেই সেনাবাহিনীর তৎপরতা দেখা যায়। মানুষের ‘অহেতুক’ রাস্তায় ঘোরাঘুরি বন্ধে তৎপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অপ্রয়োজনে রাস্তায় বের হলেই পড়তে হচ্ছে পুলিশের সামনে। মৃদু পিটুনির শিকারও হচ্ছেন কেউ কেউ। কান ধরে উঠবোসও করতে হয়েছে বিনা কারণে রাস্তায় বের হওয়ার অপরাধে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটা ছাড়া পারতপক্ষে মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছেন না।

বৈশ্বিক মহামারী রূপ পাওয়া কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লকডাউন ঘোষণার পর বাংলাদেশে এর সংক্রমণ এড়াতে আগেই বন্ধ করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর পরও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ছুটি ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ হয় বিপণিবিতান, গণপরিবহন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে কাজ শুরু করেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।

পুলিশ বলছে, করোনার কারণে গত এক মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে খুন, ডাকাতি, অপহরণ, ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধ অর্ধেকে নেমেছে। করোনার পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করণীয় নিয়ে গত বুধবার পুলিশ সদর দফতরে আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হয়। বৈঠক থেকে এসপিদের সঙ্গে ভিড়িও কনফারেন্সে কথা বলেন আইজিপি।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, করোনা আতঙ্ক ছড়িয়েছে অপরাধীদের মধ্যেও। তারা বাসা-বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে। তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা থেমে নেই। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে বিশেষ নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। করোনাভাইরাস আতঙ্কের সুযোগ নিয়ে কোনো মহল যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটাতে পারে, সে জন্য পুলিশের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তবে পুলিশের কোনো সদস্য অসুস্থ হলে তারা ছুটি নিতে পারবেন।

আইএসপিআর জানায়, বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের বাংলাদেশে সংক্রমণ এবং বিস্তৃতির ঝুঁকি বিবেচনায় সরকারের সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ থেকে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর ২৯০টি দল দেশের ৬১টি জেলায় করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। বাইরে কোনো ক্যাম্প স্থাপন না করে স্থানীয় সেনানিবাসগুলো থেকেই এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোয় সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করছে। পাশাপাশি তারা বিদেশফেরত ব্যক্তিদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনের বিষয়টিও পর্যবেক্ষণ করছে। এ কার্যক্রমে সেনাবাহিনীর আড়াই হাজারের বেশি সদস্য যুক্ত রয়েছেন বলে জানায় আইএসপিআর।

গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা একেবারেই ফাঁকা। কোনো গণপরিবহন ছিল না সড়কে। গুলিস্তানের রূপ যেন একেবারেই অচেনা। ঈদ বা অন্য বড় ছুটিগুলোতেও গুলিস্তানের ফুটপাথে থাকে হকারদের হরেক পণ্যের পসরা। পুরানা পল্টনের চিরচেনা যানজটও ছিল না গতকাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রবেশপথগুলো বাঁশ বেঁধে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মগবাজার ছিল একেবারেই ফাঁকা। দু-একজন পথচারী ছাড়া দেখা যায়নি কোনো যানবাহন। গুলশানে ছিল সুনসান নীরবতা। হাতির ঝিলে ছিল না দর্শনার্থীর ভিড়। সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন সড়কে সেনাবাহিনীর টহল দেখা গেছে।

এদিকে সরেজমিন বিমানবন্দর এলাকায় দেখা গেছে পুরো এলাকা এখন মানবশূন্য। বিমানবন্দরের সামনে সুনসান নীরবতা। দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দু-একজন সদস্য ও আনসার ছাড়া পুরো এলাকা ফাঁকা হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানে বেবিচক কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের মাধ্যমে দেশে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। এটা ঠেকাতে সরকারের নির্দেশে লন্ডন, হংকং, চীন ও থাইল্যান্ড ছাড়া আন্তর্জাতিক সব রুটে বিমান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোকাব্বির হোসেন জানান, প্রায় সব রুট বন্ধ করার ফলে বিমানবন্দরে বিমানের হ্যান্ডলিংসহ অন্যান্য কার্যক্রম কমে গেছে। আন্তর্জাতিক সব রুটে ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের মহামারী প্রতিরোধে প্রায় সবার ঘরে অবস্থানের কারণে সুনসান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে চুরি-ডাকাতি না করতে পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ রয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে নিজের বাসভবনের সামনে থেকে একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে বাড়ির আশপাশ জীবাণুমুক্ত করার কর্মসূচি উদ্বোধনের পর তিনি সংবাদিকদের সামনে একথা বলেন। সবাই সচেতন হলে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগ পরিস্থিতি ইউরোপের মত হবে না আশা প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “অহেতুক যেন ভিড় না হয়, জনগণ যাতে বের না হন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সচেতন রয়েছে, জনগণকে ঘরে থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে এবং কোথাও যেন চুরি ডাকাতি ঘটতে না পারে, সেদিকেও নজর রাখছে। গতবছরের শেষে চীনের উহান থেকে নতুন করোভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কঠোর পদক্ষেপ ও জনজীবনে বিধিনিষেধ জারি করে চীন আড়াই মাসে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। কিন্তু এর মধ্যে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বাকি বিশ্বে। সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি রয়েছে ইউরোপে। এর সবকটি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এর মধ্যে ইতালিতে সবচেয়ে বেশি। স্পেন ও ফ্রান্সেও দিন দিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে চীনের পর এখন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।


সকালে ধানমন্ডি মন্ত্রীর বাসভবনের সামনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কর্মসূচির পর সংবাদিকদের তিনি নাগরিকদের সচেতন হওয়ার ও বাসায় থাকার আহ্বান জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যারা যেখানে আছেন, সেখানে থেকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করে যাবেন। সবাইকে আহ্বান রইল, আপনারা যার যার বাসায় থাকুন, যেটা সরকার ঘোষণা করেছেন, সেই ঘোষণা অনুযায়ী এবং নিজেকে পরিষ্কার করুন, হাত ধৌত করুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করোনাভাইরাস সেল ২৪ ঘণ্টা খোলা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কোথায় কী হচ্ছে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।

http://dailysangram.info/post/411481