২৭ মার্চ ২০২০, শুক্রবার, ৪:০০

ধারাবাহিকভাবে কমছে বেসরকারি বিনিয়োগ

বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ গত ৬ মাস যাবত ধারাবাহিকভাবে কমছে। সুদহার কমিয়েও বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে ৯ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। আস্থার সঙ্কট, ব্যাংকগুলোতে কম সুদে বিনিয়োগে অনাগ্রহ, কিছু বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়া, খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাওয়াকেই বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তারা জানান, অপ্রত্যাশিত করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়েই এখন মন্দা শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থা আরো কিছু দিন চলতে থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগের শেষ গন্তব্যস্থল কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা কঠিন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই থেকে বিনিয়োগ কমা শুরু হয়। বিনিয়োগের এ নি¤œগতি এখনো চলছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা মুদ্রানীতিতে নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে ১৫ শতাংশ। কিন্তু মুদ্রানীতির এ লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে ১০ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে নেমে যায়। প্রথমবারের মতো গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমে যায়। ওই মাসে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে তা আরো কমে হয় ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

গত জানুয়ারি থেকে চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আরো কমে জানুয়ারিতে ৯ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসে। গত ফেব্রুয়ারিতেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ৯ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নীতিনির্ধারক গত মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গত এক বছর যাবত বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য নীতিসহায়তা দেয়া হচ্ছে। তার পরেও বিনিয়োগ বাড়ছে না। এর অন্যতম কারণ সুদহার চাপিয়ে দেয়া। কারণ বাজার অর্থনীতিতে সুদহার চাপিয়ে দেয়ার ফল ভালো হয় না। তিনি তার দীর্ঘ দিনের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, ১৭-১৮ শতাংশ সুদহার যখন ছিল তখনো বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। বিনিয়োগকারীদের আস্থা, পরিবেশ পরিস্থিতি, যারা তহবিল জোগান দেবেন তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনার নিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করে। নানা কারণে দীর্ঘ দিন যাবত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করে আসছে। এর ওপর গত দেড় থেকে দুই বছর যাবত সুবিধাবাদী এক শ্রেণীর ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবসায়ী গ্রুপ অসৎ উদ্দেশ্যে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যাংকিং খাতকে নিয়মনীতির মধ্যে চালানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে। তারাই সুদহার চাপিয়ে দেয়ার জন্য সরকারকে প্রভাবিত করে আসছে। এর ফলে ব্যাংকাররা বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছে। বেশির ভাগ ব্যাংক ৬ শতাংশ সুদে আমানত পাচ্ছে না। নানাভাবে তারা উচ্চ সুদে আমানত গ্রহণ করছে। কিন্তু তারা ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করতে পারছে না। ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করলে তাদের লোকসান দিতে হবে।

এ কারণেই অনেকেই বিনিয়োগ দিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। এর ওপর পলিসি রেট কমানোর ফলে সুদহার আরো কমে যাবে। ফলে সামনে ব্যাংকাররা বেসরকারি খাতে ঋণের পরিবর্তে বেশি মুনাফার আশায় সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডেই বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়ে পড়বেন। কারণ সরকারকে ঋণ দিলে এখনও ১০ শতাংশের কাছাকাছি মুনাফা পাওয়া যায়। আর সরকারকে ঋণ দেয়াটাও ব্যাংকগুলোর জন্য নিরাপদ বিনিয়োগ বলা চলে। কারণ এখানে খেলাপি ঋণ বাড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। এ কারণেই ব্যাংকগুলো এখন ট্রেজারি বিল বন্ডেই বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ছে। অপর দিকে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী গ্রুপ যারা ব্যাংক মালিক হয়েছেন তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যাচ্ছে। এখানে অন্যদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ নেই। এসব কারণেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের এমন নি¤œগতি। এর ওপর চলমান বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রভাবে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কোথায় গিয়ে ঠেকে তা এখনও ধারণা করা যাচ্ছে না। এ থেকে উত্তরণের জন্য সব ধরনের অরাজকতা কাটিয়ে উঠতে সম্মিলিত ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/491399