২৫ মার্চ ২০২০, বুধবার, ১২:৩৯

করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতিতেই ঘাটতি ছিল অনেক

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) চলতি বছরের জানুয়ারিতেই চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কৌশল ঠিক করে দিয়েছিল, সতর্কও করেছিল। তখন থেকে টানা তিন মাস সময় পায় বাংলাদেশ। এখন এসে চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বড় অংশ মনে করছেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বিপদ আঁচ করতে পারেনি। সর্বোচ্চ প্রস্তুতি আছে বলা হলেও পরিস্থিতি যত খারাপ হচ্ছে, প্রস্তুতির ঘাটতিও পরিষ্কার হয়ে উঠছে।

জানা গেছে, যেকোনো সংক্রমণের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগী শনাক্তের কিছু নিয়মকানুন ঠিক করে দেয়। কোথাও সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়লে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) র‍্যাপিড রেসপন্স টিমকে সতর্ক করে। তারা ওই রোগের উপসর্গ আছে—এমন ব্যক্তিদের শনাক্ত করে, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয় এবং হাসপাতালে পাঠায়। চিকিৎসার প্রথম স্তরে থাকে ‘ট্রায়াজ’ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি হাসপাতালে একটি করোনা কর্নার স্থাপন করার কথা। শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ নিয়ে রোগীরা সেখানে এলে চিকিৎসকেরা সম্ভাব্য রোগী শনাক্তের পর তাঁদের আইসোলেশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের সংক্রমণ থামানো এবং নমুনা সংগ্রহ করে রোগী সত্যিই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, শনাক্তকরণ ও ট্রায়াজ ব্যবস্থা থাকলে টোলারবাগের ঘটনা ঘটত না। শুধু রোগ শনাক্ত না হওয়ায় টোলারবাগের মৃত মাদ্রাসা অধ্যক্ষ নিজে ভুগেছেন, অন্যকে সংক্রমিত করেছেন। জানা গেছে, টোলারবাগের প্রথম রোগীর করোনা শনাক্ত হয় শুক্রবার, আর তিনি শুক্রবার দিবাগত রাত তিনটায় মারা যান হাসপাতালে। আর তাঁরই এক প্রতিবেশী, যাঁকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে রোববার সন্ধ্যায় মৃত ঘোষণা করা হয়, তাঁর নমুনাই সংগ্রহ করা হয় ওই দিন সকালে। ডেলটা হাসপাতালের অপর একজন চিকিৎসক এখন সংক্রমিত হয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন, পরিচালক বদরুজ্জামান আছেন কোয়ারেন্টিনে। অভিযোগ আছে, মানুষ উপসর্গ নিয়েও পরীক্ষা করাতে পারছেন না।

একজন চিকিৎসক (নিরাপত্তা বিবেচনায় নাম প্রকাশ করা হলো না) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আজ হোম কোয়ারেন্টিনের দ্বিতীয় দিন। কাশি, মাথাব্যথা, প্রচণ্ড শরীর ব্যথা নিয়ে গৃহবন্দী। সঙ্গে বুকে চাপ চাপ ব্যথা। আজ থেকে শুরু হয়েছে শ্বাসকষ্ট। আইইডিসিআরে কথা বলেছি। ওরা টেস্ট করতে রাজি না। জানি না কী হবে। ...সারা জীবন মানুষের সেবা করেছি। হয়তো শেষ মুহূর্তে একটু অক্সিজেন নাও পেতে পারি। হে আল্লাহ, তুমি আমার পরিবারকে, আমার দেশকে রক্ষা করো।’

আবার রোগ শনাক্তের পরও চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান ২২ মার্চ তাঁর ফেসবুক পোস্টে লেখেন, করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে—এমন একজন রোগী বাসায় আইসোলেশনে আছেন। তিনি বারবার হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অনবরত হেল্পলাইনে ফোন করেও তিনি কারও সাড়া পাচ্ছিলেন না। হেল্পলাইনগুলো কেবল ব্যস্তই পাচ্ছিলেন তিনি। তারপর তিনি নিজেই একটি হাসপাতালে যান এবং কর্তৃপক্ষ ভর্তিতে রাজি হয়নি। আইইডিসিআরে ফোন করলে তারা শুধু নাম লিখে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে যেতে বলে। নম্বর চাইলে বলা হয় গুগল করে সংগ্রহ করে নিতে। নম্বর নিয়ে ওই হাসপাতালে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকেন তিনি। উপসর্গ নিয়ে পাঁচ দিন বসে থাকার পর এক চিকিৎসকের সহায়তায় গতকাল সোমবার তিনি হাসপাতালে ভর্তি হতে পেরেছেন। তবে এক প্রশ্নের জবাবে আজ মঙ্গলবার দুপুরের দিকে সাহাব এনাম খান প্রথম আলোকে বলেন, রোগীর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়।

আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বরং পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা ডব্লিউএইচওর সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কিট বা হাসপাতালে চিকিৎসকদের পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সংকট বৈশ্বিক বলে দাবি তাঁর। এই মুহূর্তে কিটের কোনো অভাব নেই। পরিস্থিত ক্রমে খারাপ হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রতিদিনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রস্তুতি যথেষ্ট। আটটি হাসপাতালে ১ হাজার ৫০টি শয্যা রাখা হয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য। ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা অনুসরণ করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে কি না, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো আর আমেরিকা বা ইউরোপের মতো হতে পারব না। আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু করা দরকার ততটুকু করা হয়েছে।’

আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ও ডব্লিউএইচওর পোলিও নির্মূল কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, তাতে ঘাটতি অনেক। সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে হাসপাতালগুলো তৈরি না, ব্যবস্থাপনাতেও সমস্যা রয়েছে। রোগের উৎপত্তি হওয়ার পরই চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয় ঠিক করে সেভাবে প্রস্তুত করা যেত।

এখনো পরীক্ষায় অনীহা কেন?

সরকারের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন সরকারি একটি মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের একজন শিক্ষক। ডব্লিউএইচও যখন বারবার বলছে ‘টেস্ট, টেস্ট অ্যানড টেস্ট’, তাহলে পরীক্ষায় অনাগ্রহ কেন। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘আইইডিসিআর বলছে কিট থাকলেই হবে না। গবেষণাগারের স্বল্পতা আছে। আমার জানামতে সাত-আটটি গবেষণাগার পরীক্ষার উপযোগী। কোনো ঘাটতি থাকলেও এত দিনে সেটা পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ ছিল। ভাইরোলজিতে পাস করা চিকিৎসকের সংখ্যাও এখন কম না।’

জানা গেছে, আইইডিআর ছাড়াও আইসিডিডিআরবি, চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট, বিআইটিআইডি, ডিজডিএ, নিপসম, আইপিএইচ, বিএমআরআই এ উন্নতমানের গবেষণাগার আছে। ফেসবুকে চট্টগ্রামের বিআইটিআইডিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঘোষণা দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত সেখানে কিটের সংকটে পরীক্ষা শুরু হয়নি বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গ পিপিই
ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা অনুসারে মার্চের মাঝামাঝি চিকিৎসক, সেবাদানকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য পিপিই গাইডলাইন প্রকাশ করে সরকার। পিপিইর মধ্যে রয়েছে মেডিকেল মাস্ক, গাউন, গগলস, ফেস শিল্ড, হেভি ডিউটি গ্লাভস, জুতো (বুট/পা সম্পূর্ণ ঢেকে যায় এমন)।

আজ পর্যন্ত সব হাসপাতালে এই পোশাক পৌঁছায়নি। ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিজ উদ্যোগে মাস্ক কেনার নির্দেশনা দিয়ে পরে সমালোচনার মুখে প্রত্যাহার করা হয়। খুলনা বিভাগের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক আরও একধাপ এগিয়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজস্ব উদ্যোগে গাউন, শু কাভার, মাস্ক ও ক্যাপ তৈরি করে নিতে বলেন। রংপুরে পিপিই ছাড়া দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানানোয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দেওয়া এক চিঠিতে তিনি লেখেন, কোনো চিকিৎসক/ইন্টার্ন চিকিৎসক দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তাঁদের বিরুদ্ধ সরকারি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর মধ্যেই গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এখনো চিকিৎসকদের জন্য পিপিইর অত প্রয়োজন নেই।

ফেসবুকে বাংলাদেশ ডক্টরস ফোরাম (বিডিএফ) নামের একটি গ্রুপের অ্যাডমিন চিকিৎসক তাজিন আফরোজ। এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ৮০ হাজার। তিনি প্রথম আলোকে বলের, ‘শুরু থেকেই সর্বোচ্চ প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছিল। স্বাস্থ্য খাতে অনেক অনেক বরাদ্দের কথাও বিভিন্ন সময়ে শুনেছি আমরা। সেই বরাদ্দ কোথায় গেল, এখন সেই প্রশ্নও উঠছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যা বললেন, সেটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। চিকিৎসকদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে না। উল্টো বলা হচ্ছে চিকিৎসকেরা অজুহাত খুঁজছেন সেবা না দেওয়ার।’ তিনি আরও বলেন, চিকিৎসক সংক্রমিত হলে তাঁরা যাঁদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, তাঁরাও আক্রান্ত হবেন। এ কথাটাও কেউ ভাবছে না।

সূত্রগুলো বলছে, এর আগে যেকোনো সংক্রমণ শুরু হলেই মন্ত্রী পর্যায়ের সদস্যদের নিয়ে ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি, সচিব পর্যায়ে মাল্টি সেক্টরাল টাস্ক ফোর্স ও মহাপরিচালক পর্যায়ে টেকনিক্যাল কমিটির সক্রিয় হওয়ার কথা ছিল। টেকনিক্যাল কমিটিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্থানীয় সরকার, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সবার উপস্থিতি থাকত। সেটা এবার দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি ঠিকই, কিন্তু খোলা মনে সবার পরামর্শ নেয়নি আইইডিসিআর। শুধু বিদেশ থেকে আসা বা বিদেশিদের সংস্পর্শে আসাদের পরীক্ষা করলেই চলবে না—এমন কথাও উপযাচক হিসেবে কেউ কেউ বলেছেন। সরকার কানে তোলেনি কিছুই।

https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1646799/