২৫ মার্চ ২০২০, বুধবার, ১২:৩৭

খেটে খাওয়া মানুষ কঠিন বিপদে

করোনা পরিস্থিতি

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে আগামীকাল ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দেশের দুর্যোগ মোকাবেলায় বিষয়টি ইতিবাচক হলেও দেশের দিন এনে দিনে খায় এমন খেটে খাওয়া ও স্বল্প আয়ের মানুষ কঠিন বিপদের মধ্যে পড়েছে। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা আগামী দিনগুলো কিভাবে চলবে সেই চিন্তায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ওই সমস্ত মানুষের জীবন ধারণের নিশ্চয়তার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা না থাকায় তাদের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে তাদের জীবন ভয়াবহ দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের দাবি, আগামী ১০ দিন কাজ না করে দৈনন্দিন রোজগারের অর্থে খেটে মানুষের পক্ষে সংসার চালানো ভয়াবহ কষ্টের। এই পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে সহযোগিতা না পেলে অর্ধাহারে অনাহারে অনেককেই থাকতে হবে।

জানা গেছে, সাধারণ ছুটির মধ্যে জরুরি কার্যক্রম ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। আর এই সুযোগে ইতোমধ্যে বেশির ভাগ মানুষ গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব মহানগর ও জেলা শহর এখন খাঁখাঁ করছে। স্বল্প আয়ের ও দিন এনে দিন খেটে খাওয়া মানুষ মাথায় হাত দিয়ে কষ্টের দিনের অপেক্ষা করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকাসহ সারা দেশে নারী-পুরুষ মিলে নির্মাণ শ্রমিক রয়েছে প্রায় ৪০ লাখের মতো। নির্মাণ শ্রমিকদের ক্যাটাগরির মধ্যে রয়েছে, বাসাবাড়ি নির্মাণ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, অফিস-আদালত নির্মাণ, ইটভাঙা শ্রমিক, ঘরবাড়ি রং করাসহ অনেক কিছু। এদের মধ্যে ১০ লাখের মতো মানুষ প্রতিদিনকার রোজগারে জীবিকা নির্বাহ করে। রাজধানীতে হকার রয়েছে ১০ লাখের মতো। এদের মধ্যে রয়েছে ফুটপাথের চায়ের দোকানদার, পোশাক ও জুতা-স্যান্ডেল, বেল্ট, চশমাসহ ফুটপাথ ব্যবসায়ী, রাস্তাঘাটের বাদাম বিক্রেতা, পানি বিক্রেতা, ঝাল মুড়ি বিক্রেতা, চিপস বিক্রেতাসহ অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রয়েছে। যাদের অধিকাংশই প্রতিদিনের রোজগারে সংসার চালায়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে রিকশা-ভ্যান ও অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে এমন মানুষের সংখ্যা আছে ২৯ লাখের মতো। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই ছয় লাখের মতো শ্রমিক আছে, যারা প্রতিদিনের আয়ে সংসার পরিচালনা করে থাকে। দেশে পোশাক শ্রমিক আছে ১২ লাখের মতো। এ ছাড়াও রাজধানী ও আশপাশে সিএনজি, অটোরিকশা, লেগুনা, কাভার্ড ভ্যান, উবার, পাঠাও, ট্যাক্সিক্যাবসহ অন্যান্য পেশায় অসংখ্য মানুষ নিয়োজিত রয়েছে, যাদের বেশির ভাগ দিন আনে দিন খায়। এসব পেশার সা
থে আবার এমন কিছু লোকজন রয়েছে যারা সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন দিন চলতে পারবে। এরপর তাদের সংসার অন্য কারো সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই চালানো সম্ভব হবে না।

এ প্রসঙ্গে রিকশা-ভ্যান ও অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো: ইনসুর আলী নয়া দিগন্তকে জানান, শুধু ঢাকা মহানগরে রিকশা-ভ্যান ও অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালায় এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। দেশের এই পরিস্থিতিতে তারা কিভাবে সংসার চালাবে এ নিয়ে আমরাও শঙ্কিত। তিনি বলেন, এই মানুষগুলোর মধ্যে এমন অনেকেই আছে একদিন কাজে না গেলে পরের দিন না খেয়ে থাকতে হয়। অনেকেই আছে সর্বোচ্চ তিন দিন চলতে পারবে। এরপর অসহায় হয়ে পড়বে, কারো-না-কারো সাহায্য ছাড়া ওই ব্যক্তিগুলো কোনোভাবেই চলতে পারবে না। ফলে সরকার এসব ছিন্নমূল প্রান্তিক মানুষের কথা চিন্তা করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে তাদের পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।

ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ-ইনসাবের সাধারণ আব্দুর রাজ্জাক নয়া দিগন্তকে জানান, সারা দেশে নির্মাণ শ্রমিক আছে ৩৫ লাখের মতো। এদের মধ্যে ১০ লাখ একেবারে খুবই গরিব ও অসহায় অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করে থাকে। এক দিন কাজে না গেলে পরের দিন না খেয়ে থাকতে হয়। বিশেষ করে ইটভাঙা পুরুষ ও নারী শ্রমিক, এলাকার রাস্তা নির্মাণের জন্য আছে বেশ কিছু মহিলা শ্রমিক। দেশের এই প্রান্তিক মানুষগুলো একটি অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গেল। তিনি বলেন, আমরা আশা করব, সরকার খুব শিগগিরই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে, এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবে।

হকারদের প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী হকার্স লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক এস এম জাকারিয়া হানিফ নয়া দিগন্তকে জানান, ঢাকা শহরে ফুটপাথে ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানা উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করে এমন হকার আছে প্রায় ১০ লাখ। সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর তারা সকলেই ব্যবসা বাণিজ্য শিথিল করে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত। তার কারণ হলো এখন তো কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তারা জীবন চালাবে কেমনে? অনেকের সুযোগ আছে খাদ্য মজুদ করে রাখার। এরা তো পারবে না। তাদের সেই সক্ষমতা নেই। যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেয় তাদের কষ্টের সীমা থাকবে না।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, এই রাষ্ট্র হলো উচ্চ বিত্তদের রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্র হলো লুটেরাদের, এই রাষ্ট্র হলো সুবিধাভোগীদের। এই রাষ্ট্র থেকে সুবিধাভোগীরা সব সুবিধা ভোগ করছে, লুটেরাগোষ্ঠী সব কিছু লুট করে নিচ্ছে। তিনি বলেন, এই দেশটা স্বাধীন করেছে সাধারণ মানুষ। এখন তাদের স্বার্থ দেখতে হবে, তারা যাতে বেঁচে থাকতে পারে। এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ আবার সেই আগের জায়গায় চলে যাবে। তাদের অনেকেই হয়তো বেঁচেও থাকবে না। ড. মজুমদার বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন ভাষণ দেবেন আমি আশা করব, এসব মানুষের ব্যাপারে কথা বলবেন, সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেবেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/490973/