গতকাল বুধবার রাজধানীর মিরপুর রূপনগর ঝিলপাড় বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে কয়েকশ’ বস্তিঘর পুড়ে যায় -সংগ্রাম
১২ মার্চ ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১:০৭

রূপনগরে বস্তিতে ভয়াবহ আগুন

# কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন
স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর মিরপুরে রূপনগর আবাসিক এলাকায় ঝিলপাড় বস্তির একাংশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। আগুনে পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। এতে অন্তত তিনজন বস্তিবাসী আহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় বেলা সোয়া ১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষতির পরিমা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
স্থানীয়রা জানান, আগুন লাগার পর যে যার মতো ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে পাশের রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। অন্তত পাঁচ হাজার ঘর বস্তিতে ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। কয়েক হাজার মানুষ ঘর হারিয়েছেন। তবে সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারেননি। আগুন লাগার পর বস্তির বাসিন্দারা যে যার মতো ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। শিশু, নারীসহ গৃহহীন কয়েক হাজার মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
বস্তির ৩৪ নম্বর রোডে থাকতেন নাজমুল। তিনি বলেন, ৩২ নম্বর রোডের দিকে প্রথমে আগুন লেগেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে যায়। কিছু নিয়ে আসতে পারিনি। ঘরের ফ্রিজ, খাটসহ আসবাবপত্র নিয়ে শিয়াল বাড়ি রোডে আশ্রয় নিয়েছেন রহিমা। তিনি বলেন, মাঝামাঝি জায়গায় প্রথমে আগুন লেগেছে। ঘরে যা পেয়েছি তা নিয়ে বের হয়েছি।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স ও মেইনটেনেন্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘খবর পাওয়ার পর পর্যায়ক্রমে আমাদের ২৫টি ইউনিট আসে। আগুন লাগার পর বিভিন্ন আসবাব দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা ছিল। যে কারণে গাড়ি ঢুকতে একটু সমস্যা হয়েছে। আশপাশে প্রচুর পানি সংকট, বিভিন্ন ভবনের রিজার্ভ থেকে পানি নিয়ে আমরা কাজ করেছি। সাড়ে তিন ঘণ্টায় আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন ডাম্পিং চলছে। কোনও হতাহতের সংবাদ পাইনি। পুরোপুরি নির্বাপণের পর আমরা সার্চ করে দেখব হতাহত কেউ আছে কিনা। আগুনে বস্তির প্রায় ৫০ শতাংশ ঘর পুড়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, আগুনের মাত্রা বেড়ে গেলে বস্তির পাশের একটি ছয়তলা ভবনেও তা ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস আসতে দেরি করেছে অভিযোগ তুলে তাদের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে উত্তেজিত জনতা। এ এলাকার সাবেক কাউন্সিলর হাজী রজ্জব হোসেন জানান, বস্তির ওই অংশে হাজারের বেশি ঘর আছে। এরমধ্যে অন্তত তিন শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে বলে তারা ধারণা করছেন। তিনি বলেন, রজনীগন্ধা মার্কেট থেকে ওই বস্তির দূরত্ব সিকি কিলোমিটারের মত। এ কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেখান দিয়েই ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মানুষের ভিড়ের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাড়ি ঢুকতে শুরু হয়েছে। তাতে কাজেও বিঘ্ন ঘটেছে। আরামবাগ পয়েন্ট দিয়ে ঢুকলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কাজে সুবিধা হত। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, সংকীর্ণ গলি গিয়ে তাদের গাড়ি নিয়ে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়েছে। কাছাকাছি পানির উৎস না পাওয়ার কারণেও কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। বস্তির এই আগুনে ঘর হারানো মধ্যবয়সী নারী হাজেরা খাতুন পাশের এলাকায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। তিনি জানান, সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে যখন কাজে এসেছিলেন, তখন সব স্বাভাবিকই ছিল। পরে কাজের বাড়ি থেকে বস্তিতে ধোঁয়া উঠতে দেখে ছুটে আসেন। কিছু জিনিসপত্র বের করার চেষ্টা করলেও আগুনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় তাকে পিছিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের চোখের সামনেই ছাই হয়েছে সারি সারি ঘর। যেখানে আগুন লেগেছে, তার পাশেই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা- জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব সম্পত্তিতে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের পুনর্বাসনের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্পের নির্ধারিত স্থান।
আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে আসেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। তিনি জানান, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর জন্য পাশের একটি স্কুলে আশ্রয়ের বন্দোবস্ত হয়েছে। তাদের জন্য দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। এমপি ইলিয়াস মোল্লা বলে, রূপনগর বস্তিতে প্রায় ১০ হাজার ঘরে ৪০ হাজার কক্ষ ছিল। অধিকাংশ ঘরই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। আগুনে ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে এসে এ মন্তব্য করেন তিনি। তিনি জানান, বস্তিতে একেক নেতার ২০টা, ৪০টা করে ঘর রয়েছে। বস্তির এসব নেতার তালিকা করা হবে। বস্তিতে থাকা অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে ইলিয়াস মোল্লা বলেন, ‘এখন এসব কথা বলছে তারা কারা? তারা এতোদিন কেন বলেনি? তাদের ধরা হবে।’ তিনি জানান, একজনও খোলা আকাশের নিচে থাকবে না। যে পর্যন্ত এখানে তাদের বসবাস উপযোগী না হবে সে পর্যন্ত আমরা তাদের পাশে আছি। তাদের যেন কোনোভাবে ক্ষতি না হয়। তাদের থাকা খাওয়া, বস্ত্র, বাসস্থানসহ সব ব্যবস্থা আমরা করব।
অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে এখানকার বস্তিতে বার বার আগুন লাগে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সে বিষয়ে সংসদ সদস্যকে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে এই তিনি বলেন, ‘যদি এ কারণে আগুন লেগে থাকে, ইতোপূর্বে বলল না কেন আমাকে? যারা গ্যাসের দায়িত্বে আছে, তাদের বললো না কেন? যারা এসব অপযুক্তির কথা বলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যদি সত্যি গ্যাসের লাইনের এমন কিছু (অবৈধ সংযোগ) করে থাকে, তাহলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর ডিজি, পুলিশ আছে এখানে তাদের বলব, তাদের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।
রূপনগরে ঝিলপাড় বস্তির পাশে মিরপুর-৭ নম্বর সেকশনের চলন্তিকা বস্তিতে গতবছর অগাস্টে এবং চলতি বছর জানুয়ারিতে দুই দফা অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এবার এ বস্তিতে আগুন লাগার কারণ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে। এরআগে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোব রূপনগরে বেলুনওলায়ার বেলুন বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ড ঘটে। মুহূর্তেই বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত হয় পাঁচ শিশু। পরে হাসপাতালে মারা যায় আরও দুই শিশু। এতে আহত হয়েছিল কমপক্ষে ২৫ জন। এ বিস্ফোরণে ‘কারও হাত, কারও পা, কারও নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে যায়। কারও চেহারা ঝলছে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল আনুমানিক ৬-১৪ বছর বয়সী ১০-১২ জন ক্ষুদে শিশু। বীভৎস ও মর্মান্তিক সেই দৃশ্য দেখে বুক আঁতকে ওঠেছিল। একই বছরের ১৬ আগস্ট আরেক ভয়াবহ রূপ দেখেন রূপনগরবাসী। সেদিন সন্ধ্যায় রূপনগর থানার পেছনে চলন্তিকার মোড়ে বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়। ১০ সেপ্টেম্বর আবারও এই বস্তিতে আগুন লাগে। এতে ২ হাজার ২৪৮টি ঘর, ১ হাজার ৯৮৮টি পরিবার এবং ৬ হাজার ৭৫৪ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আর কত আগুনে পোড়া দেখব- আতিকুল: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, বারবার আগুন লাগার বিষয়ের স্থায়ী সমাধান করতে বস্তির জমির মালিকদের সঙ্গে বসা এবং পুরো জমির ম্যাপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে। গতকাল বিকালে মিরপুরের রূপনগর পোড়া বস্তি পরিদর্শনকালে এ কথা জানান তিনি। মেয়র বলেন, আর কত আগুনে পোড়া দেখব, আর কত মানুষের আহাজারি শুনব? আমি মনে করি, এ জায়গার মালিকদের সঙ্গে দ্রুত আলাপ করব। পুরো জায়গার ম্যাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করব। প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার বলেছেন এবং আমিও বিশ্বাস করি, এর একটা স্থায়ী সমাধান অবশ্যই আসবে।
আপতত এ বস্তিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা স্থানীয় সরকারের কোনো সহায়তার আশ্বাস আছে কি না জবাবে মেয়র বলেন, ‘অবশ্যই আছে। এ মুহূর্তে দায়িত্বে যারা, তাদের জন্য সংসদ সদস্য, দুই কাউন্সিলর মিলে পরিকল্পনা করেছি, কোন কোন স্কুলে কারা কারা থাকবেন এবং সেভাবে কাজ চলছে। কোথায় রান্না হবে, কোথায় খাওয়া-দাওয়া হবে সে কাজও চলছে। সিটি করপোরেশন থেকে জরুরি কক্ষ খুলতেও বলেছি। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে কাজ করছি। আমি মনে করি, বস্তিবাসী ও আমরা কেউ টেবিলের এপারে-ওপারের নয়। আমরা সবাই মানুষ, সবার বাঁচার অধিকার আছে এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে।

http://dailysangram.info/post/409681