২২ মার্চ ২০২০, রবিবার, ১:০৩

হোম কোয়ারেন্টিনের ছকে নিতে গলদঘর্ম

বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিনে ১৪ দিনের ছকে বাঁধতে প্রশাসনের কতই না গলদঘর্ম! জরিমানায়ও বাগে আনা যাচ্ছে না তাদের। এত কিছুর মাঝেও নির্মল কুমার সিংহের মতো প্রবাসীও আমাদের ‘নির্মল’ সংবাদ দেন! যিনি গত শুক্রবার দুবাই থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা জানান দিয়েছেন। এ ঘোষণা আসে তাঁর নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকেই। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আলীনগর ইউনিয়নের মধ্য তিলকপুর গ্রামের নির্মল কুমারের এমন ঘোষণা অন্যদেরও হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে উৎসাহ জোগাবে বলে মনে করছে সচেতন মহল।

এদিকে গতকাল শনিবারও হোম কোয়ারেন্টিনের নির্দেশনা না মানায় অনেককেই জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) থেকে গতকাল পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে ১৭ হাজার ৫৫৮ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রয়েছে ৫০ জন।

রাজশাহীতে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন খোদ স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তাঁরা মনে করছেন, যেহেতু বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিনে নেওয়া যায়নি তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে রাজশাহী নগরকে লকডাউন না করলে যেকোনো সময় পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। এ ব্যাপারে রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক গোপেন্দ্র নাথ আচার্য্য বলেন, ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত কর্মী নেই যে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করতে পারবে। কাজেই প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে শুরু করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন যে তালিকা তৈরি করে দেবে সেটি ধরেই আমরা হোম কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করতে পারি। ফলে ঝুঁকির মধ্যে আছি আমরা। এর জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে রাজশাহীকে লকডাউনের বিকল্প নেই।’

অন্যদিকে রাজশাহী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদ হাসান বলেন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে এক হাজার ৩০৮ জনের তালিকা পাওয়া গেছে। এগুলো খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে। সরেজমিনে রাজশাহীর রেলস্টেশন, বাসস্টেশন, রাজশাহীর সাহেববাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মানুষ এখনো অবাধে চলাফেরা করছে। করোনা নিয়ে আতঙ্ক থাকলেও চলাফেরায় তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। যদিও মুখে মাস্ক নিয়ে বের হচ্ছে অনেকেই।

সিলেটে হোম কোয়ারেন্টিনের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২২৭ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে বিভাগের চার জেলায় হোম কোয়ারেন্টিনের সংখ্যা এক হাজার ৪৪৪ জনে পৌঁছেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. আনিছুর রহমান জানান, কোয়ারেন্টিনে থাকা সবাই প্রবাসী ও তাদের স্বজন। এ ছাড়া সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে দুজন কোয়ারেন্টিনে আছে।

এদিকে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি বিয়ের অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। নির্দেশনা না মানায় অন্তত পাঁচটি বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য করেছে প্রশাসন। এ ছাড়া নির্দেশ অমান্য করায় জরিমানাও করা হয়েছে কয়েকটি স্থানে। সিলেট নগরের বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার ও কনভেনশন হলও বন্ধ করে দিয়ে নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

রংপুর বিভাগের আট জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় হোম কোয়ারেন্টিনে গেছে বিদেশফেরত আরো ১২৮ জন। এ নিয়ে এই বিভাগে হোম কোয়ারেন্টিনে আছে মোট ৭৮০ জন। তবে বিদেশফেরত এসব মানুষের অনেকেই নির্দেশনা মানছে না। এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন, কিন্তু প্রতিদিন বিদেশ থেকে এই অঞ্চলে কতজন মানুষ আসছে তার সঠিক হিসাব নেই তাদের কাছে। এদিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে রংপুরের পীরগঞ্জে সব হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

মানিকগঞ্জে বিদেশফেরত চার ভাগের তিন ভাগই হোম কোয়ারেন্টিনে থাকছে না। প্রবাসীদের মধ্যে অনেকেই ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীনের মতো করোনা আক্রান্ত ঝুঁকিপুর্ণ দেশ থেকে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।

এদিকে গতকাল শনিবার নতুন করে চট্টগ্রামে ২৩৭ জন, রাজশাহীতে ২২ জন, বরিশালে ২২ জন, পটুয়াখালীতে ১০২ জন, ভোলায় ২১ জন, পিরোজপুরে ৬৪ জন, বরগুনায় ৪১ জন, ঝালকাঠিতে ২৪ জন, মাদারীপুরে ২৯ জন, বগুড়ায় ১৩০ জন, যশোরে ৩৩৫ জন, হবিগঞ্জে ১৪৬ জন, ফরিদপুরে ৪০৬ জন, নওগাঁয় ৩৫ জন, বান্দরবানে ১৮ জন, নরসিংদীতে ১০০ জন, চুয়াডাঙ্গায় ১৭ জন, চাঁদপুরে ১৭৭ জন, নারায়ণগঞ্জে ২৫ জন, রাজবাড়ীতে ৭১ জন, সাতক্ষীরায় ২২৯ জন, নোয়াখালীতে পাঁচজন, জামালপুরে ৩২ জন, জয়পুরহাটে ছয়জন, সিরাজগঞ্জে ১৯ জন, নীলফামারীতে ৩২ জন, নড়াইলে ৩৪ জন, মেহেরপুরে ২৯ জন, শরীয়তপুরে ৬১ জন, সুনামগঞ্জে ৪৬ জন এবং গাইবান্ধায় ১১ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে কোয়ারেন্টিনের নিয়ম না মানায় ইতালিফেরত রফিকুল ইসলামকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া তাড়াশে সৌদি আরবফেরত এক নারীকে আটক করে পুলিশ পাহারায় বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে কোয়ারেন্টিনে রেখেছে উপজেলা প্রশাসন।

মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে না থাকায় উজ্জল সরদার নামের এক প্রবাসীকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। শরীয়তপুরের ডামুড্যায় হোম কোয়ারেন্টিনে না থাকায় দুই প্রবাসীকে ২২ হাজার ৯০০ টাকা অর্থদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাঁরা হলেন দুবাইপ্রবাসী মোহাম্মদ আলী ও ওমানপ্রবাসী বাপ্পি মাদবর। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে বাইরে ঘোরাফেরা করার অপরাধে হুমায়ূন কবীর নামের এক প্রবাসীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এদিকে হোম কোয়ারেন্টিন না মানায় জামালপুরে বিদেশফেরত দুজনকে ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জয়পুরহাট সদর উপজেলার তেঘরবিষা গ্রামের বিউটি খাতুন নামের দুবাইফেরত এক নারীকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় দুবাইপ্রবাসী আব্দুস সামাদকে ১০ হাজার টাকা এবং জুড়ীতে রফিকুল ইসলাম সুহেলকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। হবিগঞ্জে হোম কোয়ারেন্টিন না মেনে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করায় তুরস্কফেরত আবুল কাশেমকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে মালয়েশিয়াপ্রবাসী আল আমিনকে পাঁচ হাজার টাকা, সৌদি আরবফেরত আলমগীরকে পাঁচ হাজার টাকা এবং সিঙ্গাপুরপ্রবাসী রাজু হোসেনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সাতক্ষীরায় হোম কোয়ারেন্টিনে না থেকে প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি করায় বিদেশফেরত তিনজনকে ৬১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এদিকে গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসককে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। যশোর পুলিশ লাইনসে কর্মরত এক পুলিশ কনস্টেবলকে হোম আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক নার্স স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। এদিকে নওগাঁর বদলগাছি এলাকার এক বৃদ্ধকে তাঁর স্বজনরা গত শুক্রবার আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেখে পালিয়ে যায়। চিকিৎসকরা জানান, ২২ দিন আগে তাঁর জামাতা ওমান থেকে দেশে ফেরার পর ১০ দিন আগে তিনি দেখা করেছেন। এর পর থেকে তিনি জ্বর, সর্দি ও কাশিতে ভুগছেন।

রাজবাড়ীতে বিদেশফেরত এক হাজার ৭৮৭ জন এবং ফরিদপুরে ৮৬৭ জনের বাসায় হোম কোয়ারেন্টিন স্টিকার লাগানো শুরু হয়েছে।

এদিকে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের জারি করা বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে প্রাইভেট পড়ানোয় এক শিক্ষক এবং মসজিদে মক্তব চালু রাখার অভিযোগে ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে সাত দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেই সঙ্গে সন্তানদের কোচিং সেন্টারে পড়তে পাঠানোর অপরাধে দুই অভিভাবককে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/03/22/889005