১৬ মার্চ ২০২০, সোমবার, ১১:৪৩

ঢাকার বাতাসে কেবলই ধুলো

পথচারীদের চরম ভোগান্তি

আগে শোনা যেত ঢাকায় টাকা ওড়ে আর এখন শোনা যায়, ঢাকায় শুধু ধুলো ওড়ে। যে ধুলো নগরবাসীকে কাহিল করে দিচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনযাপনে চরমভাবে বিঘœ ঘটাচ্ছে ধুলোবালু। নগরীর এমন কোনো অলিগলি পাওয়া যাবে না, যেখানে বছরে একবার খোঁড়া হয়নি। প্রতিদিন রাজধানীর কোথাও না কোথাও খোঁড়াখুঁড়ি তো হচ্ছেই, নতুন নতুন ইমারত নির্মাণও চলছে। ফলে মানুষ রাস্তায় বের হলেই ধুলোবালু গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। মুখে মাস্ক লাগিয়েও এখন পথচলা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এই নীরব প্রাণঘাতী ধুলোয় মানুষ স্বাস্থ্যগত ও আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, ঘটছে পরিবেশের বিপর্যয়।

রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে পথচারী ইকবাল হাসান জানালেন, মুখে মাস্ক লাগিয়েও ধুলোয় নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তায় কোনো কোনো জায়গায় ধুলোবালুতে অন্ধকার হয়ে যায়, চোখে কিছুই দেখা যায় না। নাকের ভেতরে ময়লা জমে থাকে। বাসায় গিয়ে হাতমুখ ধুতে গেলে জমাটবদ্ধ ধুলো নাক-গলা থেকে বের হয়। মতিঝিলে একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন আরিফুল হক। তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব স্বল্প হলেও ধুলোর কারণে শান্তি নেই। কখনো কখনো শাপলা চত্বর থেকে একটু ইত্তেফাক মোড়ে যেতে চাইলেই ধুলোবালুতে গা ঘিন ঘিন করে। হালকা বাতাস হলে তো কোনো কথাই নেই, পুরো শরীর ধুলোবালুতে ভরে যায়। মিরপুর থেকে মতিঝিলে অফিস করেন শেখ নূরুজ্জামান। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। নূরুজ্জামান বলেন, নিয়মিত বাসে যাতায়াত করি। কিন্তু ধুলোয় রাস্তাঘাটের যে অবস্থা তাতে একটি ড্রেস একবারের বেশি পরা যায় না। মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলছে। পুরো রাস্তায় শুধু ধুলোবালু। দেশের উন্নয়নের জন্য, যাতায়াত ব্যবস্থা সুবিধার জন্য এ রকম উন্নয়নমূলক কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন আছে। তবে জনগণের ভোগান্তির দিকটিও মাথায় রাখতে হবে। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুরূহ। বাসে করে যাতায়াত করি তাতেও ধুলোবালু নাকে-মুখে লেগে থাকে। এতে আমরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছি। নয়াপল্টনে বসবাস করেন ইমরান। তিনি বলেন, রাস্তাঘাটে ধুলো তো আছেই; বাসাবাড়িতেও মারাত্মকভাবে হানা দিচ্ছে। দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখলেও কিভাবে যে বই খাতা আসবাবপত্রে চোখের নিমিষেই ধুলোর আস্তরণ পড়ে যায় তা বলে বোঝানো যাবে না। দিনে কয়েকবার ঝাড়– দিয়েও আসবাবপত্র পরিষ্কার রাখা এখন ঝামেলাপূর্ণ মনে হয়। এ রকম মতিঝিল, পল্টন, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, মিরপুর, বিমানবন্দর, উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর, টেকনিক্যালসহ পুরো রাজধানীজুড়ে ধুলোবালু এখন নগরবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ধুলো দূষণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। জনদুর্ভোগের পাশাপাশি ধুলো দূষণের কারণে শিশু ও বয়স্কদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বেড়ে যায়। শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে রোগীর প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগে ভর্তি হয়ে থাকে। অন্য দিকে ঢাকা মহানগরের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভয়াবহ ধুলো দূষণের শিকার হয়।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার পথের ধুলোয় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের অস্তিত্ব মিলেছে। মাটিতে যতটা ক্যাডমিয়াম থাকা স্বাভাবিক, ঢাকায় পদার্থটি পাওয়া গেছে এর চেয়ে ২০০ গুণ বেশি। ক্যাডমিয়ামকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বলে শনাক্ত করেছে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ, পরমাণু শক্তি কমিশন ও যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তার ধুলোয় সিসা ও নিকেলের মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। হৃদরোগ, ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে ভারী ধাতু সিসা। এ ছাড়া ঢাকার রাস্তার ধুলোর মধ্যেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়েছে। এসব ভারী ধাতু এতটাই সূক্ষ্ম যে, তা মানুষের চুলের ২৫-১০০ ভাগের বেশি ছোট। এসব সূক্ষ্ম ধাতুকণা ত্বকের সংস্পর্শে আসে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যগ্রহণ ও পানীয়ের মাধ্যমে সহজে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।

এক গবেষণার জন্য রাজধানীর ২২টি সড়কের ৮৮টি এলাকার রাস্তা, ফুটপাথ, নর্দমার পাশের মাটি ও গর্ত থেকে ৩০০ গ্রাম করে ধুলোর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত নমুনা পরে পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ৮৮টি এলাকার সবখানে ভারী ধাতু পাওয়া যায়। যেসব এলাকায় যানজট বেশি বা যান চলাচল বেশি সেখানে ভারী ধাতুর পরিমাণও বেশি। এর মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে, যেখানে ধাতু গলানো হয় সেখানেও। জিপিও, বঙ্গভবন ও রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকায় ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে।

পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ধুলো দূষণের কারণে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। ধুলো দূষণের ফলে মূল্যবান প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন, ইমারত, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন স্থাপনায় মরিচা পড়ে সেগুলোর আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিচ্ছে। দোকানের জিনিসপত্র, কম্পিউটারসহ নানা ইলেকট্রনিকস সামগ্রী দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঘরবাড়ি আসবাবপত্রসহ কাপড়চোপড়ে প্রতিদিন ধুলো জমে নোংরা হচ্ছে। এ জন্য নষ্ট করতে হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা ও বিপুল পরিমাণ পানি এবং ডিটারজেন্ট।

পবার সাধারণ সম্পাদক আবদুস সোবহান নয়া দিগন্তকে বলেন, ঢাকায় অপরিকল্পিতভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। এতে মাসের পর মাস রাস্তা নষ্ট হয়ে থাকে। মেট্রোরেলের কাজ চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। কাজ চলতেই পারে, কিন্তু পরিবেশের দিকটি বিবেচনায় রেখেই নির্মাণকাজ করলে কিন্তু ধুলোর সৃষ্টি হয় না। নগরের দেখভাল করার জন্য আছে ওয়াসা, ঢাকা সিটি করপোরেশন, ডেসাসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা। নগরবাসীকে সেবা দেয়ার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু সুফল পাচ্ছে না কেউই। তিনি বলেন, আসলে আমাদের কোনো বিভাগেই জবাবদিহিতা নেই। কাউকে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না। ফ্রি-স্টাইলে কাজ চলছে। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা: আবদুল মতিন নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০০০ সালের আগে শুনতাম বাংলাদেশে পানিবাহিত রোগে মৃত্যুর হার বেশি। ওই সময় একটি সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিও ছিলেন। তখন জানতে পারলাম, বায়ুদূষণ হচ্ছে প্রধান কারণ। তিনি বলেন, দেশে উন্নয়ন কার্যক্রম তো হবেই। এটা তো থেমে থাকতে পারে না। কিন্তু উন্নয়ন কার্যক্রম করলেই ধুলো ঢুকতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। শুধু ভারত আর আমাদের দেশেই এমন দেখা যায়। পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রে এই অদ্ভুত চিত্র চোখে পড়ে না। জাপানের উদাহরণ দিয়ে ডা: আবদুল মতিন বলেন, আমি ১৯৯৮ সালে জাপানে গিয়েছিলাম। সেখানে নির্মাণকাজ হয় অথচ পাশের লোকজন বুঝতেই পারে না। একটি বিল্ডিং নির্মাণ করলে নীল প্লাস্টিক-জাতীয় কিছু দিয়ে তার চারপাশ ঢেকে দেয়া হয়, যাতে ধুলো বের না হতে পারে। পরিবেশের যাতে বিপর্যয় না ঘটে, কিন্তু ঢাকা শহরে তার উল্টো চিত্র।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/488514/