৮ মার্চ ২০২০, রবিবার, ১:২৪

১০ হাজার টাকায় বজ্রপাত থেকে কৃষকের জীবন বাঁচাবে সেইফ জোন

*তিন দশকে বজ্রপাতে ৬ হাজার ৭৪২ জন নিহত
মুহাম্মদ নূরে আলম : জানলে অবাক হবেন সারাবিশ্বে যত মানুষ বজ্রপাতে মারা যায় তার চার ভাগের এক ভাগ মারা যায় শুধু মাত্র আমাদের দেশেই? আরো অবাক হবেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় আমাদের দেশের সুনামগঞ্জে? ২০১৭ সালেই সারাদেশে মানুষ মারা গিয়েছিলো প্রায় তিনশো জন। আর ২০১৮ সালের শুধুমাত্র এপ্রিল মাসেই মারা গিয়েছিলো ৩০ জন, এমনকি এক দিনেও বজ্রপাতে ৪৫ জন মারা যাওয়ার ঘটনাও আমাদের দেশে ঘটেছে। গাছপালা কমে যাওয়া ও পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বজ্রপাতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা। কারণ মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে কৃষকের প্রাণহানিই ঘটে সবচেয়ে বেশি। আর এক মাস পরই মাঠে কৃষকের ব্যস্ততা বাড়বে, শুরু হবে বজ্রপাতও।

দেশে অন্য যে কোনো দুর্যোগের চেয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার দিন দিন বাড়ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত ৯ বছরে বজ্রাঘাতে মারা গেছেন এক হাজার ৯৯৮ জন। বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিলেও এর ঝুঁকি প্রশমনে দৃশ্যমান উদ্যোগ কম। বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বজ্রপাতের পূর্বাভাস ও এলাকা শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও ভূমিকা রাখতে হবে।

এরই ধারাবাহিকতায় বজ্রপাত থেকে জীবন বাঁচাতে পোর্টেবল লাইটনিং প্রোটেকশন সেইফ জোন আবিষ্কার করেছে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)। এটা মূলত খোলা আকাশের নিচে বজ্রপাত থেকে কৃষকের নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা হয়েছে। মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচ করেই একজন কৃষক বজ্রপাতের আগুণ থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

কৃষি মাঠে বজ্রপাত থেকে সুরক্ষার গুরুত্ব বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। কারণ মৃত্যুর সংখ্যা অনুযায়ী ৯৭ দশমিক ৫২ শতাংশ সাধারণ মানুষ বা গ্রাম গঞ্জের কৃষক শ্রমিক, জেলে শ্রেণি। তার মাধ্যে কৃষি কাজে সম্পৃক্তদের নিহতের হার ৭৪ শতাংশ। ১০ বছরে উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে ধান কাটা, রোপন করা ও কৃষি সংযুক্ত কাজে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে একই সঙ্গে চারজন। মাঠে কাজ করার সময় কাছাকাছি কোনো নিরাপদ স্থাপনা না থাকায় বজ্রপাতের সময় কৃষক অরক্ষিত হয়ে যান। হাওর অঞ্চলের কৃষকরা আরও বেশি অসহায়। নিরাপদ স্থান পেতে কৃষকের তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। এসব কৃষককে সুরক্ষা দেবে সেইফ জোন।

আইডিইবি সূত্র জানায়, পোর্টেবল লাইটনিং প্রোটেকশন সেইফ জোনে মাত্র ১০ হাজার টাকায় ১০০ জন কৃষকের জীবন রক্ষা পাবে। মূলত একটি বাঁশের মাথায় এয়ার টার্মিনাল থাকবে। মাটির সঙ্গে সংযুক্ত করে ধাতব বস্তু দিয়ে মাটিতে আর্থিংয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে এয়ার টার্মিনাল থেকে নিচের দিকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে একটি প্রটেকশন জোন তৈরি হয়। এয়ার টার্মিনাল সাধারণত স্থাপনার ওপরে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় বসানো হয়। প্রকল্পের আওতায় সমস্ত ব্যবস্থা করবে আইডিইবি। শুধু ব্যবহারকারীরা এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করবেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ময়মনসিংহ) পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ তাঁর এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেন, সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে ২০১৬-এর ১৭ মে তারিখে, যার মূল পটভূমি ছিল ১১-১২ মে’তে প্রায় ৫৭ জনের মৃত্যু। বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো ও প্রাণহানি রোধে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হয়েছে বজ্রপাত শনাক্তকরণ সেন্সর, যা চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, ঢাকা, নওগাঁ, সিলেট, পটুয়াখালী ও পঞ্চগড়ে বসানো হয়েছে। এই সেন্সর থেকে আপাতত পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরই কেবল তা দিয়ে মানুষকে আগাম সতর্কতা জানানো সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, অথচ বিএমডি ওয়েদার অ্যাপ ব্যবহার করে অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই সেন্সর থেকে ২৫০ কিলোমিটার পরিধি পর্যন্ত পূর্বাভাসের তথ্য পাওয়া যাবে বলেই আমাদের জানা ছিল, যদিও কুমুলাস বা কুমুলোনিমব্যাস নামের বজ্রমেঘগুলো খুবই অস্থিতিশীল এবং বাতাসের গতিপ্রবাহের ওপর নির্ভর করে খুব স্বল্পসময়ে তা স্থান পরিবর্তন করতে পারে। এ ছাড়া সেন্সর দ্বারা কোথায় বজ্রপাত হচ্ছে বা হবে, মেঘ থেকে মাটিতে আঘাত করা বজ্রপাতের সংখ্যা, মেঘের স্ট্যাটিক চার্জ ইত্যাদি জানা সম্ভব। প্রায় ৮ মাস আগেই ১টি বজ্রপাত শনাক্তকরণ সেন্সর ঢাকায় আবহাওয়া অধিদফতরের বসানো হয়েছে কিন্তু তা বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে কতটুকু কাজে এসেছে আমাদের?

জানা গেছে, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বজ্রপাতে ৬ হাজার ৭৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত ৫ বছরেই বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৬৭৮ জন। গাছপালা কম থাকায় সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নওগাঁ, দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জে বজ্রপাতের হার বেশি, নিহতের সংখ্যাও বেশি। ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের (আইডিইবি) গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

আইডিইবি সূত্র জানায়, বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালেই বজ্রপাতে ৪৪৯ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম নিহত হয়েছেন ২০১৯ সালে (১৯৬ জন)। ২০১৫ সালে ২৭৪, ২০১৬ সালে ৩৮৭ ও ২০১৭ সালে নিহত হয়েছেন ৩৭২ জন। এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা বেশি। বিগত পাঁচ বছরে এপ্রিলে ১৮২, মে মাসে ৫৪৯, জুনে ২৮০ ও জুলাই মাসে ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন। তবে মৃত্যুহার কম জানুয়ারি নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে।

আইডিইবি সূত্র জানায়, দক্ষিণ বঙ্গপসাগর থেকে সক্রীয় মৌসুমী বায়ু প্রবাহ, উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশে পুঞ্জীভূত মেঘ, বায়ু দূষণ, মোবাইল টাওয়ার হতে উৎপন্ন অতি মাত্রার ম্যাগনেটিক ফিল্ড ওয়েব, বন জঙ্গল উজাড় ও পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে বজ্রপাত বাড়ছে।

ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের রিসার্চ ফেলো ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপনে ঝুঁকি কমে না। কারণ, বজ্রপাত আঘাত করলে সেটি মাটির ওপরে ছড়িয়ে পড়ে। ঝুঁকির আরও নানা কারণ রয়েছে। নাসাও এ বিষয়ে কাজ করছে। বজ্রপাত থেকে সুরক্ষার লক্ষ্যে অ্যাপ বানানোর চেষ্টা চলছে। এর মাধ্যমে অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে জানা যাবে কোথায় বজ্রপাত হবে। হুঁইসেল পদ্ধতিসহ নানা প্রযুক্তিতে জাপান এ বিষয়ে সফলতা পেয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশেও তা অনুসরণের পরামর্শ দেন তিনি।

বজ্রপাতে নিহত হওয়া প্রসঙ্গে আইডিইবি রিসার্চ ফেলো প্রকৌশলী মো. মনির হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, পৃথিবীতে তাপমাত্রা বাড়ছে। বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে বাৎসরিক প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বজ্রপাতের প্রবণতার হার ১৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। হাওর অঞ্চলে বজ্রপাতের হার বেশি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন কৃষকরা। হাওর অঞ্চলে বজ্রপাতে থেকে সুরক্ষা দিতে পোর্টেবল লাইটিং প্রোটেকশন সেইফ জোন ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা মাঠের মাঝখানে থাকবে বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলেই কৃষকেরা এই জোনে প্রবেশ করবেন। মাঠের আয়তন অনুযায়ী এটা স্থাপন করা যেতে পারে। একটা সেইফ জোনে ১০০ জনের জীবন রক্ষা পাবে। কৃষকের সুবিধা অনুযায়ী এগুলো স্থাপন করা যাবে। প্রকল্পের আওতায় কম খরচে বজ্রপাত থেকে সেইফ জোন জীবন রক্ষা করতে পারবে। মাঠে সেইফ জোন থাকলে চাষিরা মাঠেও মনবল নিয়ে কাজ করতে পারবেন।

বজ্রপাতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে আবহাওয়াবিদ ড. আব্দুল মান্নান বলেন, একসময় দেখা যেত নির্দিষ্ট একটি জায়গায় বজ্রপাত হয়। এখন তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বজ্রপাতের সময়েও এসেছে পরিবর্তন। খোলা মাঠে অবস্থানরত মানুষই সবচেয়ে উঁচু, তাই মানুষের ওপর বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে। তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে বজ্রপাতের ঝুঁকি বৃদ্ধির একটি যোগসূত্র রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্রের আধুনিকায়ন ও নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা গেলে এই ঝুঁকি ক্রমেই কমানো সম্ভব। এরই মধ্যে সরকার বেশকিছু যন্ত্র ব্যবস্থা করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর এগুলো নিয়ে গবেষণাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের পরিচালক (আইসিটি অ্যান্ড ইনোভেশন) মুশফিকুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, বজ্রপাত পূর্বাভাস পদ্ধতি আরও জোরালো করতে পারলে ঝুঁকি কমে আসবে। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শনাক্তকরণ যন্ত্র তৈরি করে তা স্থাপন করলে বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে পূর্বাভাসের আওতায় আনা যেতে পারে। এ বিষয়ে তাদের কয়েকটি গবেষণা চলমান রয়েছে।

ইউনিসেফের ডিআরআর বিশেষজ্ঞ আনোয়ার হোসেন বলেন, বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ কৃষক বা জেলে। এখানে বড় একটি অংশ রয়েছে শিশু। ইউনিসেফ সব সময় তাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। বৃক্ষনিধন এবং বায়ুদূষণের কারণেও বজ্রপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের হিউম্যানিটারিয়ান প্রোগ্রামের পরিচালক মোস্তাক হুসাইন বলেন, অন্য দুর্যোগের সঙ্গে বজ্রপাতের আলোচনাকে আরও প্রাধান্য দেওয়া উচিত। পূর্বাভাস ব্যবস্থা চালু হলে এর সুফল আসবে। হাওরের উঁচু জায়গায় হিজল গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি।

http://dailysangram.info/post/409250