২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, রবিবার, ২:০২

নগরজুড়ে তারের জঞ্জাল

ফের বিদ্যুৎ বিভাগের আল্টিমেটাম : ৬টি এলাকা তারবিহীন করার উদ্যোগ

ঝুলন্ত তার ও বিদ্যুতের লাইন ভূ-গর্ভে নিয়ে দেশের প্রথম তারবিহীন শহরে নাম লিখিয়েছে সিলেট। ওই শহরের তারবিহীন সড়কে হাঁটলে অনেকেই হয়তো ভুলে যাবেন তিনি বাংলাদেশ নাকি অন্য কোনো দেশের সড়কে হাঁটছেন। অথচ রাজধানীর সড়কগুলোর সৌন্দর্য্য বাড়াতে ১২ বছর আগে ঝুলন্ত তার অপসারণের এই উদ্যোগ নিয়েছিল টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি। এজন্য ভূ-গর্ভস্থ কমন নেটওয়ার্ক করতে লাইসেন্স দেয়া হয় ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন্স ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের (এনটিটিএন)।

ঝুলন্ত তার অপসারণে গত ১২ বছর ধরেই ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি) ও ক্যাবল অপারেটরদের (ডিস সংযোগ প্রদানকারী) আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে বার বার। কমিটি গঠন করে বিভিন্ন সময় একেকটি সড়কের ঝুলন্ত তারও কেটেছে ওই কমিটি। তবে তার কেটে দেয়ার ২-৪ ঘণ্টা পরেই আবারও তার ঝুলিয়ে সড়ককে পুরনো রূপে ফিরিয়ে নেয় আইএসপি ও ক্যাবল অপারেটররা। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, গুলিস্তান, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, ধানমন্ডি মিরপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রধান সড়ক কিংবা গলি পথ সর্বত্রই ঝুলছে তারা। বিদ্যুতের পিলার ব্যবহার করে এসব তার ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীজুড়ে। প্রতিটি পিলারের সাথে পাকিয়ে ফেলা হয়েছে তারের কূন্ডলি। ঝুলে থাকা এসব তারের মাধ্যমেই মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হওয়াসহ নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটছে। জঞ্জালের মতো এসব তার নষ্ট করছে ঢাকার সৌন্দর্য্যও। রাজধানীর সড়কগুলোতে ঝুলন্ত তার (ক্যাবল) অপসারণে সরকার নানা পদক্ষেপের কথা বলেছে। সংশ্লিষ্ট সকলের সাথেই কয়েক দফা বৈঠক করেছেন বিদ্যুৎ মন্ত্রী ও সচিব। দেয়া হয়েছে দফায় দফায় আল্টিমেটাম। তবে কোনো কিছুই কাজে আসছে না।

নতুন করে আবার রাজধানীর ৬টি এলাকায় ঝুলন্ত ইন্টারনেট ও ডিসের তারসহ সকল তার অপসারণের জন্য ৩০ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ওই সময়ের মধ্যে তার অপসারণ না করলে তার কেটে দেয়াসহ সংশ্লিষ্ট আইএসপি ও ক্যাবল অপারেটরের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে গতমাসে বৈঠক করেছি। বৈঠকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে ৩০ মে’র মধ্যে সকল তার অপসারণ করতে হবে। এরপর যেসব প্রতিষ্ঠানের তার পাওয়া যাবে তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। তিনি বলেন, রাজধানীর ৬টি এলাকায় আমাদের টিম পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছে যে, এসব এলাকা আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলের জন্য প্রস্তুত। তাই এসব এলাকায় আর ঝুলন্ত তার থাকার সুযোগ নেই।

বিপু বলেন, এটি আমাদের প্রথম পদক্ষেপ, এরপর রাজধানীর অন্যান্য এলাকা এবং বিভাগীয় শহরগুলোতেও তা করা হবে। বিদ্যুতের তার আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে এটি ধানমন্ডিতে করা হচ্ছে। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে আগামী ৫ বছরের মধ্যে সারাদেশের শহরগুলোতে সকল তার মাটির নিচে হবে।

জানা যায়, রাজধানীর সড়কের সৌন্দর্য বাড়াতে এবং কম খরচে নিরবিচ্ছিন্ন দ্রæতগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে ২০০৮ সালে ঝুলন্ত তার অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল বিটিআরসি। এজন্য বিটিআরসি’র তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঞ্জুরুল আলম রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ভূ-গর্ভস্থ কমন নেটওয়ার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি এনটিটিএন গাইডলাইন তৈরি করেন। ওই গাইডলাইন অনুযায়ী, ফাইবার অ্যাট হোম এবং সামিট কমিউনিকেশন্স রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কাজ শেষ করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ এলাকায় ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাবল টিভি অপারেটররা অভিন্ন এই নেটওয়ার্কে যুক্ত না হয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ক্যাবল টেনেছে।

এই ক্যাবল অপসারণ করতে প্রথম দফায় ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। ২০১৪, ১৫, ১৬, ১৮ সালে এবং সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতেও এনটিটিএন অপারেটর, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান (আইএসপি), ক্যাবল অপারেটরদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিটিআরসি। ওইসব বৈঠকে ক্যাবল অপারেটর ও আইএসপিদের সতর্ক করে দেয়া হয় তার সরানোর জন্য এবং অভিযানের পর যেন আর তা উঠানো না হয়। কিন্তু এই তারের জঞ্জাল সরেনি।

পরবর্তীতে আর কোন কার্যকর পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিটিআরসি। ফলে আবারও বিপজ্জনক তারের জঞ্জাল রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের বৈদ্যুতিক খুঁটি দখল করে ফেলছে। যদিও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ ওই কমন নেটওয়ার্কে ঢুকতে মাশুল বেশি ধরছে সংশ্লিষ্ট দুই কোম্পানি। মিলছে না চাহিদা অনুযায়ি স্থানে কোর সেবাও। যে কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা চিন্তা করে কোনও-কোনও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ওই নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছে।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, ঝুলন্ত তারের মাত্র ২০-৩০ শতাংশ ভূগর্ভে স্থানান্তরিত হয়েছে। বাকি ৭০-৮০ শতাংশ এখনো রাস্তায় ঝুলছে। শুধু তাই নয়, বড় রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি থেকে ঝুলন্ত তার সরিয়ে নেয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে আইএসপি এবং ক্যাবল টিভি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো গলিপথে আরো ঝুঁকিপূর্ণভাবে তার ঝুলিয়েছে। মূল সড়কের ঝুলন্ত তার এখন সরু গলিপথেও ছড়িয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীতে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রায় ৬০টি আইএসপি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সংযোগের প্রায় পুরোটাই বিদ্যুতের খুঁটি নির্ভর।

স¤প্রতি সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান বেকায়দায় পড়েছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে বারবার ধরণা দিচ্ছে এখনই যাতে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয়। অভিযোগ আছে, বিটিআরসি, বিদ্যুৎ বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার কারণেই রাস্তায় ঝুলন্ত তার সরানোর কাজে বিলম্ব হচ্ছে। ফলে বিপজ্জনক তারের জট থেকে নগরবাসী মুক্তি পাচ্ছে না।

এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত মাসের মাঝামাঝি বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), বিটিআরসি, আইএসপি, ক্যাবল অপারেটর, এনটিটিএন ও সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন আগামী ৩০ মে’র মধ্যে রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএস, গুলশান, বনানী, নিকেতন, কারওয়ান বাজার ও মতিঝিল এলাকার সকল ঝুলন্ত তার অপসারণ করতে হবে। সড়কের সৌন্দর্য বাড়াতে ও অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়াতে এটি বাস্তবায়নের জোর দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বৈঠকে উপস্থিত একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি জানান, বৈঠকে সকলের উদ্দেশ্যে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সকল তার অপসারণ করতে হবে। ৩০ মে’র পর যেসব আইএসপি ও ক্যাবল অপারেটরের তার থাকবে তা কেটে ফেলা হবে এবং সংশ্লিষ্ট আইএসপি ও ক্যাবল অপারেটরের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এরপরও তার টানালে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও জানানো হয়।

ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)-র সাধারণ সম্পাদক ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংগঠন মো: এমদাদুল হক বলেন, এতো বড় মার্কেটে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানকে এনটিটিএন লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তারা পুরো ব্যবসাকে মনোপলি করেছে। আন্ডারগ্রাউন্ট ক্যাবলে তারা যে প্রাইস চায় এতে গ্রাহকদের বিদ্যমান রেটে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে না এবং গ্রাহক পর্যায়ে সেবার মূল্য অনেক বৃদ্ধি পাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এনটিটিএনের মূল্য কমানো এবং সরকারের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান হবে না বলে মনে করেন এমদাদুল হক।

ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেন ফাইবার অ্যাট হোমের গভর্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান আব্বাস ফারুক। তিনি বলেন, প্রতি মিটারের জন্য ২টাকাই আছে, বাড়ানো হয়নি। এরপরও আমরা বিটিআরসিকে বারবারই বলেছি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য। কমিশন যে মূল্য নির্ধারণ করে দেবে সেটিতে সেবা দিতে আমরা বাধ্য। আর আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো যে দুটি এনটিটিএনের কথা বলেছে সেটি ঠিক নয়, লাইসেন্সধারী ৫টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, গ্যাস, বিদ্যুতের যদি একটি লাইন থাকতে পারে তাহলে ভূগর্ভস্থ একটি নেটওয়ার্কের সমস্যা কোথায়? আব্বাস ফারুক বলেন, তাদের নেটওয়ার্ক আইএসপি অপারেটরগুলো যতবেশি ব্যবহার করবে তত কম মূল্যে তারা সেবা গ্রহণ করতে পারবে। কারণ এটি একটি মহাসড়কের মতো। মহাসড়কে যতবেশি গাড়ি চলবে ততই চার্জ কমে যাবে।

জানতে চাইলে বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো: জাকির হোসেন খান বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ ঝুলন্ত তার অপসারণে কাজ করছে। বিটিআরসি সার্বিকভাবে সেই কাজে সহযোগিতা করছে। আমরা আমাদের লাইসেন্সিকে সেই নির্দেশনা মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা দিয়েছি।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, আমরা এনটিটিএন লাইসেন্স দিয়েছি এই উদ্দেশে যে, তারা ক্যাবলগুলোকে এমনভাবে নেবে যাতে মানুষের জীবন-যাত্রার কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে এতে কোনো পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি না। তিনি বলেন, আইএসপিকে লাইন টানার জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়নি। তাদেরকে লাস্ট মাইল সার্ভিস দিতে হবে এবং এনটিটিএন থেকেই সংযোগ নিতে হবে।

তাঁর মন্ত্রণালয় কোনো চাপ সৃষ্টি করবে কি না জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেন, আমাদের দায়িত্ব লাইসেন্স দেয়া, বাকি কাজগুলো যাদের তারা যদি বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় তাহলে এটি সম্ভব। আমি নিজেই মনে করি সিটি করপোরেশন এলাকায় ঝুলন্ত তার থাকা উচিত না। সকল তার মাটির নিচে নেয়া উচিত। ঝুলন্ত তার থাকতে পারে হাওর এলাকায়।

https://www.dailyinqilab.com/article/270240