২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, রবিবার, ১:৫৮

করোনাভাইরাসের প্রভাব

প্রবাসী আয়ে নতুন শঙ্কা

করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এর ফলে বিশ্বের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক।

প্রবাসী আয় নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন শঙ্কা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণেই এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া ভাইরাসটি ইতিমধ্যে অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে বড় অংকের রেমিটেন্স আসে এমন দেশও রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইতালি, কানাডা, জাপান, হংকং, আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এ ভাইরাস। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করা বাংলাদেশিদের তিনজন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব দেশ থেকে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। ফলে সব মিলিয়ে রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি এ প্রথম ৭ মাসে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ১ হাজার ১০৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে মাত্র ৩০টি দেশ থেকে এসেছে ১ হাজার ৯১ কোটি ডলার। বাকি রেমিটেন্স আসে অন্যান্য দেশ থেকে। রেমিটেন্স পাঠানোর শীর্ষ ১৬ তে অবস্থান করছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটি এখন ব্যাপক আকারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এভাবেই আরব আমিরাত দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে, মালয়েশিয়া ৫ম, ইতালি ৯ম, জাপান ২৪তম, হংকং ২৭তম এবং প্রবাসী আয়ের দিক থেকে চীন ৩০তম।

এখন পর্যন্ত চীনে করোনাভাইরাস ভয়ানক রূপ নিয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবেই চীনে ২ হাজার ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে ৭৭ হাজার। এচাড়া উল্লিখিত সব দেশ করোনাভাইরাসে হাবুডুবু খাচ্ছে। কেননা চীনের অর্থনীতি বিশাল হওয়ায় সব দেশেই চীনের প্রভাব রয়েছে। ফলে ওইসব দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। করনোয় আক্রান্ত দেশগুলোর সঙ্গে পণ্য রফতানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে ওইসব দেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া এসব দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে চলে আসছেন। এতে আগামী দিনগুলোতে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহও কমে আসবে। একই সঙ্গে ব্যবসায়িক মন্দার কারণেও রেমিটেন্স প্রবাহ কমবে। কেননা বাংলাদেশে বড় অংকের রেমিটেন্স আসে এমন অনেক দেশই সরাসরি করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া করোনার প্রভাব রয়েছে।

দেশের মোট রেমিটেন্সের মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এ চার দেশ থেকে আসে ১১ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আসে সোয়া ১২ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসে প্রায় ৬০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে সাড়ে ১১ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসে সাড়ে ৭ শতাংশ।

আলোচ্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে ইতিমধ্যে এশিয়া প্যাসিফিকের দেশগুলোতে করোনার প্রভাব ভয়ানক রূপ নিয়েছে। ইউরোপীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশও করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সৌদি আরব থেকে। এ দেশটিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আসে। এখানেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে এসব দেশে কর্মরত অনেক প্রবাসীই যেমন বাংলাদেশে চলে আসছেন। তেমনি দেশ থেকে নতুন করে ওইসব দেশে কোনো কর্মী যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে করোনাভাইরাসের সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে এ খাতে নেতিবাচক অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৭ শতাংশে। পরের দুই অর্থবছরে আবার প্রবৃদ্ধির হার কমে যায়। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে আড়াই শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কমে সাড়ে ১৪ শতাংশ। এ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি মাথায় নিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ হার বাড়ে প্রায় সাড়ে ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ আগের ঘাটতি সমন্বয় করলে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৩ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ২১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের বিপরীতে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এ কারণে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এদিকে দেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ, আমদানি ব্যয়ের সাড়ে ২৯ শতাংশ মেটানো হয় রেমিটেন্স দিয়ে। কেননা রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি। যে কারণে রফতানি আয় দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় না। ফলে রেমিটেন্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

করোনা দীর্ঘায়িত হলে সমস্যা আরও বাড়বে: ড. জাহিদ হোসেন

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিশ্বে বর্তমানে একধরনের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এর নেতিবাচক প্রভাব কমবেশি অনেক দেশেই পড়েছে। এই মন্দার একটা প্রভাব প্রবাসী আয়ে পড়তে পারে। কেননা যেসব দেশে এই মন্দা জেঁকে বসছে, সেসব দেশের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে।

ফলে কাজের ক্ষেত্র কমে যাবে। এতে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যেতে পারে। এছাড়া জনশক্তি রফতানি এবং বিদেশে যারা অবস্থান করছেন, তাদের ওপর করোনাভাইরাসের সাময়িক প্রভাব তো আছেই। কেননা করোনাভাইরাস যেভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে।

যেসব দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে, সেসব দেশে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তবে এর প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে সমস্যা আরও বাড়বে। তখন রেমিটেন্সের পাশাপাশি অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু: ড. আহসান এইচ মনসুর

অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সিঙ্গাপুরে পাঁচজন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া লেবাননে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাসটি। কোনো রাষ্ট্রই এখন নিরাপদ নয়। এসব কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কেননা করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী পণ্যের চলাচল যেমন কমে গেছে, তেমনি কমে গেছে মানুষের চলাচল। এতে কমে যাচ্ছে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড। করোনায় বেশি আক্রান্ত হয়েছে চীন। সে দেশে পর্যটন ব্যবসায় মারাত্মক ধস নেমেছে। এর সঙ্গে অন্যান্য ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। ভেঙে পড়েছে উৎপাদন, ব্যবসা ও বাণিজ্য। ফলে চীনের অর্থনীতি বড় হওয়ার কারণে এখন অনেক দেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বড় অর্থনীতির দেশগুলো এখন চীনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এ কারণে বড় অর্থনীতির দেশগুলোয়ও করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ওইসব দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে বাধ্য। এর মধ্যে আমদানি, রফতানি ও রেমিটেন্সেই বেশি পড়বে।

প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো কঠিন: মো. শফিকুর রহমান

সাবেক এমডি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শফিকুর রহমান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ভিসা জটিলতাসহ নানা কারণে প্রতিদিন ফেরত আসছেন প্রবাসীরা। এতে ওইসব দেশ থেকে রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক ধারা দেখা দিতে পারে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হচ্ছে করোনাভাইরাস। ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যেও এই ভাইরাস হানা দিয়েছে। রেমিটেন্সের অর্ধেকেরও বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এসব কারণে ঊর্ধ্বগতির রেমিটেন্স নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেননা মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক প্রবাসী দেশে চলে আসছেন। করোনার প্রভাব অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। ইতিমধ্যে আমদানি-রফতানিতে ব্যাপক হারে পড়ছে করোনার নেতিবাচক প্রভাব। চায়নায় নতুন এলসি খোলা বন্ধ। আগের এলসি নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একধরনের স্থবিরতা চলছে। এসব কিছুর মধ্যেই রয়েছে রেমিটেন্স। কোনোভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে পারবে না রেমিটেন্সও।

https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/281361/