৮ ডিসেম্বর ২০১৯, রবিবার, ১২:৫৪

বড় ঘাটতিতে বাজেট

বাস্তবায়নের শুরুতেই ধাক্কা

অর্থবছরের প্রথম দিকেই সরকারের আয় ও ব্যয়ের পার্থক্য আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে, যা সচরাচর দেখা যায় না। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাজেটের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। রাজস্ব আয়ের ধীরগতি, বৈদেশিক ঋণের ছাড় কমে যাওয়া এবং সুদ পরিশোধের চাপে এ অবস্থা। অর্থনীতিবিদরা এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলছেন। তারা মনে করছেন, বাজেটের ঘাটতি ও এর অর্থায়নের ফলে তৈরি হওয়া পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় এরই মধ্যে ফাটল দেখা গেছে। এ দুর্বলতা অর্থনীতির আরও কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এবার প্রথম তিন মাসে বাজেট ঘাটতি ৩৭ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এর মানে, ওই পরিমাণ অর্থ সরকার ঋণ করেছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে যা ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাজেটের জন্য সরকার ১৯ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ ছিল। পুরো অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সাধারণত জিডিপির ৫ শতাংশ। এবারও তাই ধরা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এবার মনে হচ্ছে ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে না। ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে রাখাকে আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম চর্চা মনে করা হয় এবং বাংলাদেশ এর মধ্যেই রাখতে চায়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়াকে দুশ্চিন্তার কারণ মনে করছেন। সমকালকে তিনি বলেন, প্রথম দিকে ব্যয়ের হার খুব একটা বাড়ে না। এবার হয়তো একটু বেশি। অন্যদিকে, রাজস্ব আয়ের গতি অন্যান্য বারের চেয়ে কম। সরকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আবার আগে থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে চাপ বেড়েছে। সব মিলিয়ে আয় ও ব্যয়ের পার্থক্যটা বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে সরকার ব্যাংক থেকে বেশি বেশি ধার নিচ্ছে।

কে এ এস মুরশিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় পুঞ্জীভূত ঋণ এখন পর্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ে যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণের চাপ বেড়ে যাওয়া অর্থনীতির জন্য সতর্কবার্তা। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বহুদিন ধরে এক ধরনের স্থিতিশীলতার মধ্যে ছিল। মনে হচ্ছে, ইদানীং সেখানে কিছুটা ক্ষয় হচ্ছে। একে পুনরুদ্ধার করা দরকার এবং প্রথমেই দৃষ্টি দিতে হবে রাজস্ব আয় বাড়ানোর ওপর।

সরকার চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছে। এর জন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। তিন মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয় করেছে ৪৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আয় বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ ছিল। প্রথম প্রান্তিকে এনবিআর তার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজস্ব আয়-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। গত পাঁচ বছরে এ অনুপাত গড়ে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। উন্নয়নশীল এশিয়ায় এ হার প্রায় ২৭ শতাংশ।

জানা গেছে, প্রথম তিন মাসে সরকারের পরিচালন ও রাজস্ব ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির জন্য ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছিল। উন্নয়ন ব্যয়ের হার কিছুটা কমেছে। সরকারের পরিচালন ব্যয় বিশেষত, সুদ পরিশোধের জন্য ব্যয় বেড়েছে। তিন মাসে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি সুদ গুনতে হয়েছে সরকারের। গত কয়েকটি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে সুদ পরিশোধে চাপ বেড়েছে।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সমকালকে বলেন, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা আগে নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইদানীং সেখানে ফাটল ধরেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে। সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রাক্কলন অবাস্তব। আবার যতটুকু সম্ভব ছিল, ততটুকু আদায় হচ্ছে না। সরকারের ব্যাপক বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে। এ কারণে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছে, যা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বিঘ্নিত করবে। সামষ্টিক অর্থনীতির এক জায়গা দুর্বল হলে অন্য জায়গাও দুর্বল হয়ে পড়বে। সরকারের ঋণ মাত্রাতিরিক্ত হলে মূল্যস্ম্ফীতি ও বিনিময় হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর সুরাহা কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণের বড় পাইপলাইন রয়েছে। সেখান থেকে ঋণ দ্রুত ছাড়ের পদক্ষেপ নিতে হবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজেটের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা রাজস্ব আদায় কম হওয়া। গত সাত-আট বছর জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় ক্রমে নিচের দিকে যাচ্ছে। এবার রাজস্ব আদায়ের অবস্থা আরও খারাপ। এ অবস্থায় সরকারের বড় এডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে অনেক বড় অঙ্কের ঋণ নিতে হবে। এত দিন বাজেট ঘাটতি বছর শেষে ৫ শতাংশের মধ্যে ছিল, যা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য সহায়তা করেছে। এবার মনে হয়, ঘাটতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।

আহসান মনসুর বলেন, অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অবস্থা খারাপ হয়েছে এবং পরের দুটি প্রান্তিকে আরও খারাপ হবে। চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য অঙ্কের না বাড়ালে অর্থনীতি বেশ বেকায়দায় পড়ে যাবে। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বেসরকারি খাত চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাবে না। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকার চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংক থেকে নিট ঋণ নিয়েছে ২৭ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল মাত্র ৫০১ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত উৎস (বেশির ভাগই সঞ্চয়পত্র থেকে) ঋণ নিয়েছে পাঁচ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এই উপাদানে ঋণ বেশি ছিল, পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। বিদেশ থেকে নিট ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা পাঁচ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা ছিল।

https://samakal.com/bangladesh/article/19126289/