১ নভেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ১২:৫১

ব্যয় বাড়ছে ২৫৯ কোটি টাকা

রুয়েটের উন্নয়ন প্রকল্প স্থবিরতা

টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় থাকা সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। বাস্তবায়ন চলছে কচ্ছপগতিতে। তবে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে খরগোশের লাফের গতিতে। অন্য প্রকল্পের মতোই এই চিত্র ফুটে উঠেছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে। তিন বছর সাত মাসে যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা সেটা গত ২ বছর ৭ মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর অর্থ ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। যেখানে এই বাস্তবায়ন হার হওয়ার কথা ছিল ৭০ শতাংশ। এখন ব্যয় বাড়ছে ২৫৯ কোটি টাকা। গত তিন বছরে ১৪টি ভবন নির্মাণের কাজও শুরু করা হয়নি বলে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের এক কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

রুয়েটের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, রুয়েটের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক ল্যাবরেটরি, শিক্ষার বিভিন্ন ধরনের সুবিধা বৃদ্ধি, আবাসিক ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণে ২০১৭ সালে ৩৪০ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। যা আগামী ২০২০ সালের জুনে শেষ করার কথা। প্রকল্পের মূল কাজ ছিল, ১০তলা ভিতের ওপর ১০তলা পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবন, ছাত্রী হল, ছাত্র হল, স্টাফ কোয়ার্টার, যন্ত্রকৌশল অনুষদ ভবন, পুরকৌশল অনুষদ ভবন, তড়িৎ ও কম্পিউটার কৌশল অনুষদ ভবন নির্মাণ, ১০তলা ভিতের ওপর ১০ তলার টিচার ডরমেটরি নির্মাণ। এ ছাড়া ২ তলা ভিতের ওপর ২তলা পর্যন্ত ভিসির বাংলো-কাম-অফিস নির্মাণ এবং ৩ তলার একটি মেডিক্যাল সেন্টার নির্মাণ এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিন্তু গত জুন পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৪.২৩ শতাশ। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গত তিন বছরে ১৪টি স্থাপনার একটিরও কাজ শুরু করা হয়নি। উল্টো আরো দু’টি ভবন নতুন করে নির্মাণ করার প্রস্তাব যুক্ত করা হয়েছে। অনুমোদিত ডিপিপিতে যতগুলো ভবণ নির্মাণের সংস্থান ছিল সবগুলোর আয়তন বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদনের তিন বছর পর এসে এত পরিবর্তন সঠিক হয়নি। একটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি পেশাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এটা কাম্য নয় বলে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ বলছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অভিমত হলো, প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মাস্টার প্ল্যানটি প্রদান করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী প্রস্তাবনা করা হয়ে থাকলে তা অবশ্যই প্রকাশ করা হতো।

ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনুমোদিত মূল ডিপিপিতে বৈজ্ঞানিক ও ল্যাব যন্ত্রপাতির জন্য তিন হাজার ৬৯৯টি আইটেমের নাম ছিল। তার বিপরীতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। যার মধ্যে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত প্রস্তাবনায় দুই হাজার ৭১৪টি আইটেমের নাম এই খাতে উল্লেখ করা হয়েছে। যার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৭৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আগের তুলনায় আইটেমের পরিমাণ কমলেও এবং ১২ কোটি টাকার আইটেম কেনার পরও এখন ব্যয় আগের চেয়ে ১০ কোটি ৩০ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এখানে ডিপিপিতে ৫৫ লাখ টাকায় পিকআপ কেনার বরাদ্দ রেখে সেটাকে অতিক্রম করে সংশোধিত প্রস্তাবনায় তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে পিকআপ কেনা হয়েছে। অনুমোদিত অর্থের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থে পিকআপ কেনা ক্রয় পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী। সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্পের নির্মাণকাজের কোনো ডিজাইন সংযোজন করা হয়নি। এমনকি প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনায় সরকারি ক্রয় বিধি-২০০৮ সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি। ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভবন ও ল্যাব নির্মাণের আগেই বৈজ্ঞানিক ও ল্যাব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও ল্যাব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে ১১ কোটি ৯৪ লাখ টাকার।

ব্যয় বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক জানান, গণপূর্ত অধিদফতরের হালনাগাদ রেট শিডিউল অনুসরণ, প্রয়োজনীয়তার নিরীখে কিছু ভবনের সম্প্রসারণ, নতুন করে ছাত্র ও ছাত্রী হল নির্মাণ, প্রফেসরস ও অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরস কোয়ার্টার নির্মাণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার কারণে ব্যয় বৃদ্ধি ও সময় দুই বছর বাড়ানো হয়েছে।

রুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এম রফিকুল ইসলাম শেখের সাথে গতকাল প্রকল্পের ব্যাপারে রাতে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, তিনি মাত্র কয়েক মাস হলো এই রুয়েটে যোগদান করেছেন। বর্তমানে একটি ভবন নির্মাণ কাজ চলমান আছে। আরেকটি কাজ করার জন্য পুরাতন ভবন ভাঙা হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের সারসংক্ষেপে একেবারেই যে কাজ শুরু হয়নি বলা হয়েছে তা সঠিক না। তাদের তথ্য পুরনো।

প্রকল্পের কাজে কচ্ছপগতি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে যে ডিজাইন করা হয়েছিল এবং ডিপিপিতে গোলমাল ও অসামঞ্জস্যতা ছিল। ডিজাইনে অনেক ভুলভ্রান্তি পাওয়া গেছে। রুয়েট একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের নকশা ও পরিকল্পনাকে সবাই অনুসরণ করবে। সেখানে আমরাই যদি ভুল ডিজাইন দিয়ে ভবন নির্মাণ করি তাহলে সেটা ঠিক হবে না। তাই আমরা নতুন করে ডিজাইন ও নকশা করি। এতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আলো বাতাস যাতে সহজে প্রবেশ করতে পারে সে মোতাবেক নকশা করা হয়েছে। আর এই কাজ করতে গিয়ে বেশ সময় চলে যায়। তিনি বলেন, প্রথমে যখন করা হয় তখন গণপূর্ত বিভাগের যে রেট শিডিউল দিয়ে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল এখন ২০১৮ সালের রেট কার্যকর। তাই চলমান রেট শিডিউল অনুসারে নির্মাণ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। ফলে ব্যয় বৃদ্ধি পাবেই। আর এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য আমরা আরো দুই বছর সময় বর্ধিত করার জন্য প্রস্তাব করেছি। আমরা এখন একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি। অনুমোদন পেলেই পুরোদমে কাজ শুরু করা হবে।

আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্যসচিব আবুল কালাম আজাদের সাথে গতকাল প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের বেশির ভাগই সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় না। কারণ এটা করতে গেলে সময় নিয়ে করতে হয়। সেটা তারা করতে চায় না। কিন্তু ২৫ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাই করা আবশ্যিক বিধান রয়েছে। তিনি বলেন, অনুমোদন নেয়ার পর নতুন নতুন খাত যুক্ত করে তারা। ডিপিপিতে নতুন খাত যুক্ত করে তা অনুমোদনের জন্য তদবির করেন। যার কারণে প্রকল্পগুলো নির্ধারিত ব্যয় ও সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

 

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/452681/